মুনসুর রহমান: জেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়েছে। গত ১০ দিনে সাতক্ষীরায় ৩৩০ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। মঙ্গলবার (১৪ জুলাই ২০২০) পর্যন্ত সাতক্ষীরায় ৩২ জন নতুন সংক্রমিতসহ মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪২২ জন। একই সময়ে এ পর্যন্ত জেলায় মারা গেছে ১০ জন। গত একমাস আগেও এ সংখ্যা মাত্র ৫০ এর নিচে ছিল। আক্রান্তের দিক থেকে এখন নতুন হটস্পট হচ্ছে সাতক্ষীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে বাড়তে থাকলে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামকেও। ঢাকাসহ সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা চলমান থাকায় জেলার মানুষের মধ্যে করোনা সংক্রমণের ঝুুঁকি প্রবল।
খবরের সূত্রে প্রকাশ, গত ৮ মার্চ দেশে সর্বপ্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হলেও জেলায় গত ২৬ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় এবং অফিসিয়ালি জেলায় প্রথম ৩০ এপ্রিল করোনা রোগী শনাক্ত হয়। শুরুর দিকে সংক্রমণের সংখ্যা কম থাকলেও ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে। গত ১২ জুলাই ২০২০ জেলায় একদিনে সর্বোচ্চ ৪৪ জন করোনা সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছিল। তবে গত ২৪ ঘন্টায় ৩২ জন ব্যক্তির শরীরে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ে। এ নিয়ে জেলায় সর্বমোট করোনা রোগীর সংখ্যা ৪২২ জন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধাকি ব্যক্তি জানান, সীমিত আকারে ও শর্তসাপেক্ষে দোকানপাট, শপিংমল থেকে শুরু করে সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার অনুমতি দিয়েছে সরকারের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধিরা। সে ধারাবাহিকতায় দোকানপাট খুলছেও। এতে স্বাভাবিক কারণেই রাস্তায় যানবাহন ও মানুষের চলাচল বেড়েছে। শহরে গত এক সপ্তাহ ধরেই বাড়ছে লোকসমাগম ও যানবাহনের সংখ্যাও। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের জন্য আগে মোবাইলকোর্ট পরিচালিত হলেও এখন তাও কম দেখা যাচ্ছে। ফলে এ সুযোগটিকে পুরোপুরি কাজে লাগাচ্ছেন মানুষ। তারা ইচ্ছেমতো বের হচ্ছেন। এতে ভেঙ্গে পড়েছে সামাজিক দূরত্ব ব্যবস্থাপনাও।
তারা আরও জানান, জেলার বাইরে ৩ থেকে সাড়ে ৩ লক্ষ মানুষ পেটে তাগিদে কাজ করেন। তাদের মধ্যেও অধিকাংশ মানুষের শিক্ষার হার অতি নগন্য। তারা করোনা সংক্রমিত এলাকার লকডাউন উপেক্ষা করে জেলায় প্রবেশ এখনও চলমান রেখেছে। দিনের পর দিন জেলায় বহুগুণে বৃদ্ধি পাচ্ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা; তা নিয়ে সকল উপজেলাজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করলেও করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পরীক্ষাগার স্থাপনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি স্বাস্থ্যবিভাগের কোনো কর্মকর্তারা। এমনকি পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রিতার জন্য করোনা রিপোর্ট আসতে দেরি হলেও করোনা উপস্বর্গে আক্রান্ত ব্যক্তিরা দেদারছে জেলার মোড়ে মোড়ে, চায়ের দোকান, হাটবাজার, রাস্তাঘাটা ও বিভিন্ন জনসমাগম এলাকায় ঘুরাঘুরি করছে। তাদেরকে ঘরে রাখতে জেলার করোনার প্রতিরোধ কমিটির প্রতিনিধিদের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। মহাদুর্যোগ করোনা থেকে জেলার মানুষকে প্রাণে বাঁচাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।
জেলার সচেতন মহল জানান, করোনার সংক্রমণ থেকে জেলার মানুষকে প্রাণে বাঁচাতে সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা দীর্ঘদিন পিসিআর ল্যাব স্থাপনের দাবি করলেও তা নির্মাণের আজও কোনো উদ্যোগ স্বাস্থ্য বিভাগ নেয়নি। আমরা চাইবো অনতিবিলম্বে যেন করোনা রোগীদের শনাক্তের জন্য নির্ধারিত সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের ১০০শ’ শয্যা হাসপাতালেই পিসিআর ল্যাব স্থাপন করা হয়।
সিভিল সার্জন অফিসের মূখপাত্র ডাঃ জয়ন্ত সরকার জানান, মঙ্গলবার (১৪ জুলাই ২০২০) পর্যন্ত করোনা উপস্বর্গে সন্দেহে ২৮৮৮ জন ব্যক্তির স্যাম্পল গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০৯১ জনের রিপোর্ট পাওয়া গেছে এবং পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রিতার জন্য ৭৯৭ জনের রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায়নি। তবে গত ২৪ ঘন্টায় ৩২ জনসহ মোট ৪২২ জনের শরীরে করোনা পজেটিভ ধরা পড়ে এবং সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন ১৬৮ জন এবং করোনা আক্রান্ত হয়ে ১০ জন এবং করোনা উপস্বর্গে ৪৫ জন মৃত্যুবরণ করেছেন।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডাঃ হাবিবুর রহমান জানান, শুনেছি সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে পিসিআর ল্যাব স্থাপনের অনুমোদন হয়ে গেছে। এছাড়াও ইঞ্জিনিয়ার সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের পিসিআর ল্যাব স্থাপনের রুম পরিদর্শন করে গেছেন। কিন্তু মেশিন সংকটের জন্য আজও তা স্থাপন হয়নি। গত শনিবার (১১ জুলাই ২০২০) জনপ্রশাসন সচিব কলেজে আসছিলেন। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন খুব শীঘ্রই সাতক্ষীরায় পিসিআর ল্যাব স্থাপন হবে। তবে কতদিনের মধ্যে ল্যাব বসবে তা বলেননি।
সিভিল সার্জন ডা: হুসাইন সাফাওয়াত জানান, সারাদেশের পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন উপজেলার সঙ্গে আন্তঃযোগাযোগের কারণে এখানে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এই আন্তঃযোগাযোগ আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর রুপ নিয়েছে। জেলায় এখনও পিসিআর ল্যাব স্থাপন না হওয়ায় সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছি আমরাও। তিনি আরও জানান, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম মতো করোনার নতুন হটস্পট হতে যাচ্ছে সাতক্ষীরা। এমনকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জেলার ১৭ টি ইউনিয়নের একাধিক গ্রাম রেডজোন, ১৬ টি ইয়েলোজোন এবং বাকিগ্রামগুলোকে সবুজজোনে ঘোষণা করেছিল। জেলায় করোনা উপস্বর্গে মৃত্যু ও করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের বাড়ি লকডাউন স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধিরা করলেও তা ফলোআপ না থাকায় সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এখনই দরকার জেলার লকডাউনকৃত বাড়ির ব্যক্তিদের তদারকি করা। আর তা করতে ব্যর্থ হলে জেলার হাজার হাজার মানুষ করোনা সংক্রমিত হবে। তিনি জানান, ভৌগোলিক অবস্থানের দিক বিবেচনায় সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরা সবচেয়ে বেশি করোনা ঝুঁকিপূর্ণ। এখন সাতক্ষীরার মানুষ মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সামনে সাতক্ষীরার জন্য কঠিন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। সেজন্য জেলায় দ্রুত পিসিআর ল্যাব স্থাপন জরুরী।
Leave a Reply