জিয়াউল হক মুক্তা
এক.
সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে সর্বদলীয় বিপ্লবী সরকার গঠনের আহ্বান ও দেশ পুনর্গঠনের ১৫ দফা প্রস্তাব দিয়েছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের সংগঠক মুক্তিযোদ্ধা-ছাত্র-যুব-তরুণশক্তি। বঙ্গবন্ধু তা শোনেন নি। ফলে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। জাসদ একটি সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন; এর লক্ষ্য সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। আনুষ্ঠানিকভাবে দল গঠনের আগে থেকেই জাসদ-ছাত্রলীগ-শ্রমিকলীগ-কৃষকলীগের নেতাকর্মীদের ওপর শাসকদের খড়্গ নেমে এসেছিল— এরপর তা চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৭৪-এর ১৭ মার্চের পর। ১৯৭৩-এর নির্বাচনে জাসদ মাত্র দুটি আসন পায়— জাসদের প্রার্থীদেরকে মনোনয়নপত্র দাখিলের আগে অপহরণ করা, আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করা, ভোট ডাকাতি করা আর ভোটের ঘোষিত ফলাফলও পাল্টে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটে— যেমন, খোন্দকার মোশতাকের বিপরীতে আব্দুর রশিদ ইঞ্জিনিয়ারকে বেতারে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়, কিন্তু পরে হেলিকপ্টারে করে সব ব্যালটবাক্স ঢাকায় এনে পুনর্গণনার মাধ্যমে মোশতাককে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় । ১৯৭৫-এ বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে আইনী রাজনীতির অধিকার হরণ করা হয়। পুরো সময়জুড়ে খুন-গুম-সন্ত্রাস-নিপীড়ন-রক্তক্ষরণ হয়ে ওঠে দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীর ভাগ্য। সমাজতন্ত্রের পথে এ বৈপ্লবিক সংগ্রামের সময় দলের নেতাকর্মীগণ দল ত্যাগ করেন নি।
দুই.
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খোন্দকার মোশতাকের আমলে খুন-গুম-সন্ত্রাস-নিপীড়ন-রক্তক্ষরণ থেমে থাকে নি। আওয়ামী লীগের তখন কোন অস্তিত্ব ছিল না। জাসদকে মোকাবেলা করতে হয়েছে মোশতাকের আক্রমণ [যারা ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত ‘প্রেরণার মুখ’ নামে জাসদের শহীদদের অসম্পূর্ণ তালিকাটি দেখেছেন— দেখতে পাবেন খোন্দকার মোশতাক কোথায় কাদের হত্যা করেছেন। এখানে অন্য একটি উদাহরণও দেয়া যাক। বঙ্গবন্ধু হত্যার ১৫ দিন পর ১৯৭৫ সালের ৩০ আগস্ট খোন্দকার মোশতাকের শাসনামলে জাসদের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার তার বেইজ-এলাকা রংপুর থেকে গ্রেফতার হন ও অমানুষিক নিপীড়নের শিকার হন। ২৫ অক্টোবর তাঁকে ঢাকায় এনে গোয়েন্দা বিভাগের কার্যালয়ে রাখা হয় এক সপ্তাহ ও ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়। ৩ নভেম্বর চার জাতীয় নেতার জেল-হত্যার পরপরই তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়। পরে জিয়ার সামরিক আদালতের রায়ে তাকে দুবছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। ১৯৭৭ সালের ১৩ জুলাই তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।] এ সময়ও দলের নেতাকর্মীগণ দল ত্যাগ করেন নি। এ পর্যায়ে বিপর্যস্ত জাসদ পুরোপুরি উঠে দাঁড়াতে না পারলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে বক্তব্য রেখেছে। তাত্ত্বিকভাবে মনে করেছে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির বিরুদ্ধে অন্যদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
তিন.
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর শহীদ কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তমের নেতৃত্বে ও জাসদ-গণবাহিনী-সৈনিকসংস্থার উদ্যোগে সংঘটিত মহান সিপাহী-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেন। সুপরিকল্পিতভাবে দলকে ছিন্নভিন্ন নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেন। কর্নেল তাহেরকে হত্যা ও দলের প্রধান নেতাদের কারাগারে অন্তরীণ করেন। সারা দেশে গুপ্তহত্যা, বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা মামলা, হুমকি, বিনা বিচারে আটক ও লোভ দেখানোর মাধ্যমে জাসদের অনেককে জিয়া নিজ শিবিরে সমবেত করেন। এমনকি নেতৃত্বের কারো কারো মধ্যে জিয়ার সাথে আপোষের প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। দলে নেতৃত্বশূন্যতা দেখা দেয়। জিয়া এমনকি একটি শিখন্ডি জাসদও বানানোর চেষ্টা করেন। জিয়ার বিরুদ্ধে দল কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে নি। দলের হাজারো নেতা-কর্মী জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে নিজেদের জীবন রক্ষা করেন। ৭ নভেম্বরের মহান সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবার পর জাসদ এসময়ও গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে। ১৯৭৯-র সংসদে জাসদ ৮টি আসন পায়।
চার.
১৯৮০ সালে দল ভেতর থেকে দ্বিমুখী সংকটে পড়ে। একদিকে, সিরাজুল আলম খানের গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার তত্ত্ব ও কর্মসূচি— যা কাউন্সিলে [এর সুবিধাবাদী অংশগুলো বাদ দিয়ে] সংশোধন করে গ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে, জাসদ মেজর এম এ জলিল ও আসম আব্দুর রবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে সাথে নিয়ে ১০ দলীয় ঐক্যজোট গঠনের উদ্যোগ নিলে ‘চেতনার আশি সাল, জাসদ হলো বাকশাল’ শ্লোগান দিয়ে দলের একটি অংশ সে ঐক্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। সে সময় মতাদর্শ ও অতীত আন্দোলনের মূল্যায়ন নিয়ে দলে একটি অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম চলমান ছিল। সে সংগ্রামের একটি ধারা— দল ও ছাত্র সংগঠনের জনপ্রিয় নেতা আফম মাহবুবুল হক ও মাহমুদুর রহমান মান্নাকে সামনে রেখে খালেকুজ্জামান ও মুবিনুল হায়দার চৌধুরীরা— আওয়ামী লীগ আমলে নিগৃহীত নেতা-কর্মীদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে ১০ দলীয় ঐক্যজোট গঠনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাঁরা আরও বলেন জাসদের ভেতরে থেকে বিপ্লব করার প্রক্রিয়া চালু করা সম্ভব নয়। তাঁরা দলত্যাগ করেন। ব্যাপক সংখ্যক তরুণের দলত্যাগে দলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। তাঁরা বাসদ গঠন করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্যকে নাজায়েজ বলে যাঁরা বাসদ গঠন করলেন, ১৯৮৩ সালে তাঁরাই আবার জাসদ ও আওয়ামী লীগের সাথে ১৫ দলীয় ঐক্যজোটে যোগ দিলেন।
পাঁচ.
১৯৮১ সালে সিরাজুল আলম খান দলে দ্বিতীয় আঘাত হানেন— তিনি তত্ত্ব দেন, দেশ ও জাতি গঠনে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা নিঃশেষিত হতে চলেছে এবং পেশাজীবীদের ভূমিকা হবে গুরুত্বপূর্ণ। জাসদ তার মতের দ্বিতীয় অংশ গ্রহণ করলেও প্রথমাংশ গ্রহণ করে নি। ১৯৮১-র বিশেষ কাউন্সিলে দল ‘সমন্বয় কমিটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ’ ও ‘১৮ দফা কর্মসূচি’ গ্রহণ করে। সিরাজুল আলম খানের প্রস্তাবের আলোকে পেশাজীবীদের একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা থেকে সংসদে ২০০ প্রতিনিধি প্রেরণের রাজনৈতিক প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৮০ সালে মেজর এম এ জলিল ত্রিদলীয় ঐক্যজোট থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার পর থেকে মেজর এম এ জলিল ও আসম আব্দুর রবের দ্বন্দ্ব তীব্রতর হতে থাকে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখলের জন্য উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলেন; আসম আব্দুর রব তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, গর্ত থেকে মাথা বের করলে তা ফাটিয়ে দেয়া হবে।
ছয়.
১৯৮২ সালে সাত্তার সরকার উচ্ছেদ করে এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর জাসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৮৩-র মধ্য-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিরাজুল আলম খান ও জলিল-রব সর্বাত্মক আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন; এ আন্দোলনকে সিরাজুল আলম খান ক্ষমতার অংশীদার হবার জন্য এরশাদের সাথে দরকষাকষির উপায় হিসেবে ভাবছিলেন। কিন্তু দলের অপরাপর নেতৃত্ব দলের তাত্ত্বিক নির্দেশনা অনুযায়ী ‘গণঅভ্যুত্থান’-এর মাধ্যমে এরশাদকে উৎখাতের পক্ষে অবস্থান নেন; কোনো দরকষাকষির মাধ্যমে নয়। ১৯৮৩-র মার্চের প্রথম দিকে সিরাজুল আলম খান সব পক্ষকে ‘ধৈর্য ও সহনশীলতা’র মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলার আহ্বান জানান ও পরে সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে বাড়াবাড়ি বলেন; রাষ্ট্র ও দেশ পরিচালনায় সেনাবাহিনীর অংশীদারিত্বের তত্ত্ব হাজির করেন; এবং ক্যান্টনমেন্টগুলোতে বৈঠক করতে থাকেন। আসম আব্দুর রবও ১৯৮৩-র ছাত্র আন্দোলনের ওপর থেকে আগ্রহ হারান; যদিও তিনি বৃহত্তর আন্দোলন গড়ার জন্য ইতোমধ্যে গঠিত ১৫ দলের ১১ দফায় জাসদের পক্ষে স্বাক্ষর করেছিলেন। আসম আব্দুর রব— মেজর এম এ জলিলকে নেতৃত্ব থেকে অপসারন করতে— সিরাজুল আলম খান [তাঁর দিক থেকে দলের ওপর তাঁর তৃতীয় আঘাত], শাজাহান সিরাজ ও মীর্জা সুলতান রাজার সমর্থন পান।
সাত.
দলের ওপর সিরাজুল আলম খানের চতুর্থ আঘাত— ১৯৮৩-র মার্চের শেষের দিকে তিনি আকস্মিকভাবে জাতীয় কমিটির সভায় পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে জাসদ, শ্রমিক লীগ ও কৃষক লীগের সকল কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। কমিটি তাঁর এ পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে তাঁকে জাতীয় কমিটির সভায় এসে মতামত জানানোর অনুরোধ করে তাঁর কাছে প্রতিনিধি-দল পাঠায়। তারপরও তিনি সে সভায় আসেন নি। এদিকে জলিল-রবের দ্বন্দ্ব নিরসন করতে দল কর্তৃক মেজর জলিলের এককভাবে বিবৃতি ও সাক্ষাৎকার দানের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। রব তাতেও সন্তুষ্ট হন নি। পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেন— পত্রিকায় বলেন যে তিনি মনযোগ দিয়ে সংসার করবেন, সাংবাদিকতা করবেন ও চাকুরি করবেন। জাসদ অপরাপর দলকে নিয়ে ১৫ দলের নেতৃত্বে সামরিক শাসন বিরোধী গণ-আন্দোলন অব্যাহত রাখে।
আট.
এর মধ্যে মেজর এম এ জলিলও জাসদ ত্যাগ করেন ও অন্য দল গঠন করেন। তাঁর দলত্যাগ দলের সাংগঠনিক কাঠামোয় কোনো প্রভাব না ফেললেও এতে দলের ইমেজের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
নয়.
পদত্যাগের কিছু দিন পর আসম আবদুর রব পাল্টা ছাত্রলীগ গঠন করেন। ১৯৮৪ সালে আবার জাসদ গঠন করেন ও উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এরশাদের শাসনপ্রক্রিয়াকে বৈধতা দেন । সিরাজুল আলম খানও তাঁকে সহায়তা দিতে থাকেন; এটা দলের ওপর তাঁর পঞ্চম আঘাত। খান-রব তাঁদের কাল্টের অনুসারীদেরকে সাথে পান। খান-জলিল-রবের দলত্যাগে দলের ব্যাপক শক্তিক্ষয় হয় ও ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। কিন্তু সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জাসদের আপোষহীন আন্দোলনের ফলে সারা দেশে তরুণদের মধ্যে জাসদ আবারও জায়গা করে নেয়।
দশ.
১৯৮৬ সালে শাজাহান সিরাজ ও মীর্জা সুলতান রাজা আওয়ামী লীগ ও সিপিবিকে অনুসরণ করে এরশাদের অধীনে সংসদ নির্বাচনে যেতে দল ত্যাগ করেন ও আলাদা জাসদ গঠন করেন। জাসদের মতো ১৫ দলও ভেঙে যায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮ দল নির্বাচনে যায়; জাসদের নেতৃত্বে ৫ দল স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ১৯৮৮-র সংসদ নির্বাচনে ৫ দল, ৭ দল ও ৮ দল অংশগ্রহণ করে নি। আসম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজ প্রমুখগণ তাতে অংশগ্রহণ করেন ও ধিকৃত হন।
এগারো.
১৯৯০ সালে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদের পতনে দল একটি রাজনৈতিক বিজয় অর্জন করে। গণতন্ত্রের সংগ্রামে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব প্রদান করার পরও ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল কোনো আসন না পাওয়ায় দলের নেতা-কর্মীগণ আশাহত হন। এ প্রেক্ষাপটে অভ্যন্তরীন সাংগঠনিক বিরোধে ঢাকায় ছাত্রলীগের শক্তিশালী অবস্থান কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বারো.
১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে— দলের বড়-মাঝারি-ছোট নেতা এবং আগের এক দশকের বেশি সময়ের ছাত্রলীগের বিখ্যাতসব সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকগণ প্রায় সকলে— আসা-যাওয়া বন্ধ করে দেন। যাঁদের কাছে দলের প্রত্যাশা ছিল যে তাঁরা জাসদ নেতৃবৃন্দের টিম-মেট হয়ে দলকে নেতৃত্ব দেবেন— তাঁরা ব্যবসা, চাকুরি ও পড়াশোনার জন্য দল ছেড়ে চলে যান। ওই এক দশকের সকল ছাত্রনেতৃত্বের মধ্যে দলে রয়ে যান একমাত্র একজন— শিরীন আখতার। দলের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রীয় নেতা শরীফ নূরুল আম্বিয়াও সার্বক্ষণিকভাবে ব্যবসা করতে চলে যান। কাজী আরেফ আহমেদ ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে দল হতাশার-সংকট মোকাবেলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন সারাদেশের তরুণ-সংগঠকদের নেতৃত্বে। যুদ্ধাপরাধ বিচার আন্দোলন এগিয়ে নিতে দল সারাদেশে ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। জাসদ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী আরেফ আহমেদ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধাপরাধ বিচার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রীয় ও জাতীয় নেতৃত্ব হিসেবে ভূমিকা রাখেন।
তের.
শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনতার বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলতে জাসদ বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করে। বাম ফ্রন্ট নিয়ে দলে ভিন্ন মত থাকলেও দলকে সে প্লাটফর্মে যুক্ত থাকতে হয়েছে। বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য এক ধরনের ‘মার্কটাইম’ নীতি অবলম্বন করতে হয়েছে। ১৯৯৬-এর নির্বাচনেও দল কোন আসন না পাওয়ায় দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে হতাশা আরও গভীর হতে থাকে।
চৌদ্দ.
১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনের পর আসম আবদুর রবের একটি নির্ধারক ভোটের সমর্থনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যায়। আসম আবদুর রব সরকারের মন্ত্রীসভায় স্থান পান। জাসদ ১৯৯৭ সালের ৩১ অক্টোবর আসম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাসদ ও বাসদ (মাহবুব)-এর একাংশকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ জাসদের যাত্রা শুরু করে। দল বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে আসে। সারা দেশে দলে সাড়া পড়ে।
পনের.
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা, ৩ নভেম্বরের ক্যু ও ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার পর থেকে জাসদ সবসময় যে রাজনীতি করার চেষ্টা করেছে— তা হলো, আওয়ামী লীগ ও সমমনাদের সাথে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনার ঐক্যের রাজনীতি। আসম আবদুর রব মন্ত্রীসভায় থাকলেও সে ঐক্যকে আদর্শিক ভিত্তি দিতে এবং রাজনৈতিকভাবে কাঠামোবদ্ধ করতে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। দলের সভাগুলোর সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সে আদর্শিক-রাজনৈতিক-সাংগঠনিক চুক্তির উদ্যোগ নেয়ার ফলে— জাসদ ঐক্যের মাত্র চার বছরের মাথায় ২০০১ সালে আসম আবদুর রব আবারও আগের বারের মতোই রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দেন। দলের কাউন্সিলে তাঁর চেয়ার ফাঁকা রেখে অধিবেশন সম্পন্ন হয়। তিনি দলে ফিরে আসেন নি। অনেক পরে, আগের মতোই, আবার তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি নামে একটি দল গঠন করেন।
ষোল.
২০০১ সালের পর থেকে জাসদ বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংগঠনিক-কৌশলগত কর্মসূচি পালনের ধারাবাহিকতায়— আওয়ামী লীগ ও জাসদের মধ্যে, জাসদ ও ১১ দলের মধ্যে এবং জাসদ, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও ১১ দলের মধ্য ২৩ দফার রাজনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে— জামাত-যুদ্ধাপরাধী-জঙ্গী ও এদের জন্মদাত্রী বিএনপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় প্লাটফর্ম ১৪ দল গড়ে তোলায় উদ্যোগী ও নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে। এক সাথে আন্দোলন, এক সাথে নির্বাচন ও এক সাথে দেশ পরিচালনার জন্য ১৪ দল ঐকমত্যে পৌঁছে।
সতের.
২০০৮ সালে ১৪ দল ঐক্যবদ্ধভাবে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। জাসদ তিনটি আসন পায়; এর মধ্যে দুটিতে আওয়ামী লীগ কোনো প্রার্থী না দিয়ে জাসদের প্রার্থীকে সমর্থন দেয়; একটিতে ১৪ দলের প্রার্থী হিসেবে জাসদ নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়। সরকার পরিচালনার এক পর্যায়ে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপিকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। কৃষিতে সহায়তা, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বর্ধিত বরাদ্দ, পোষাক শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি এবং স্বনির্ভর জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মতো জাতীয় উদ্যোগ গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারিক কার্যক্রম আবার শুরু হয়। যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়; সংবিধান বাহাত্তরের মূল চেতনায় ফেরত যায়। কর্নেল তাহের হত্যার বিচার হয়। যুদ্ধাপরাধী-জঙ্গী-আগুনসন্ত্রাসী ও এদের জন্মদাত্রী বিএনপির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী রাজনৈতিক প্রতিরোধ আন্দোলন ও বিচারিক উদ্যোগ গড়ে তোলা হয়।
আঠারো.
২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে জাসদ পাঁচটি আসনে জয়লাভ করে; সাথে যোগ হয় একটি সংরক্ষিত আসন— শহীদ কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম-এর স্ত্রী লুৎফা তাহেরকে দলের পক্ষে সে সংরক্ষিত আসনে মনোনীত করা হয়। পূর্বোক্ত আন্দোলন ও উদ্যোগগুলো অব্যাহত থাকে।
উনিশ.
২০১৫ সালে দলের জাতীয় কমিটির এক সভায় দলের নাম পরিবর্তন ও সমাজতন্ত্রকে আদর্শ হিসেবে পরিত্যাগের দাবি জানান দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য জনাব শরীফ নূরুল আম্বিয়া; তাঁর সাথে যোগ দেন দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য জনাব নাজমুল হক প্রধান— তিনি দলের নাম পাল্টে ‘জাতীয় সমতা দল’ রাখার প্রস্তাব করেন। অবিলম্বে সরকারের মন্ত্রীসভা ও ১৪ দল থেকে দলকে সরে এসে বিরোধী দল হিসেবে আন্দোলন করার দাবী জানান ডা. মুশতাক হোসেন। এবং জাগতিক সুবিধার জন্য এ দুই পক্ষের সাথে যোগ দেন জনাব মইনউদ্দিন খান বাদল। সব মিলিয়ে তাঁরা তিন পক্ষ এক হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে ২০১৬ সালের কাউন্সিলে দলের ঘোষিত রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। দলের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো কাউন্সিল সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন অনুমোদন না করে তা প্রত্যাখ্যান করে। দলে আদর্শহীন-সুবিধাবাদী ধারার জনাব মইনউদ্দিন খান বাদল, সমাজতন্ত্র-বিরোধী পুঁজিবাদী আদর্শের প্রতিভু জনাব শরীফ নূরুল আম্বিয়া ও জনাব নাজমুল হক প্রধান এবং অতি-বাম চিন্তার ডা. মুশতাক হোসেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে মধ্য-বাম চিন্তার নেতা হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচনকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে হাসানুল হক ইনুকে ব্ল্যাকমেইল করতে তারা কাউন্সিল কক্ষ ত্যাগ করেন এবং মাঝরাতে প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় দলের নতুন কমিটি ঘোষণা করেন। দলের অফিস, নির্বাচনী প্রতীক এবং এমনকি নামও [যা তারা পরিবর্তনের দাবি করেছিলেন] দখলের জন্য তারা বিবিধ প্রয়াস চালান। কিন্তু আইন প্রত্যেক ক্ষেত্রে জাসদের পক্ষে রায় দিয়েছে। তারা এখন বাজাসদ নামে নিবন্ধনহীন একটি কথিত রাজনৈতিক দল।
কুড়ি.
২০০১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধী-জঙ্গী-আগুনসন্ত্রাসী ও এদের জন্মদাত্রী বিএনপির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যে রাজনৈতিক প্রতিরোধ আন্দোলন ও বিচারিক উদ্যোগ গড়ে তোলা হয়— তাতে এরা কিছুটা পিছু হঠেছে; কিন্তু বিপদ কাটে নি। যে কোনো সময় এরা চাকু মারতে পারে। তাই জাসদ মনে করে এ আন্দোলন একদম ছেড়ে দেয়া যাবে না; বরং এখন দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে এদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখতে হব। এখন লড়াইয়ের প্রথম ফ্রন্ট হবে দুর্নীতি-দুঃশাসন-অপশাসন-শোষণের বিরুদ্ধে সুশাসন-সমতা-সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম।
একুশ.
কালের যাত্রায় অনেকে হারিয়ে যাবেন— এই স্বাভাবিক। কিন্তু জাসদকে হারাতে হয়েছে অনেক অনেক বেশি। জাসদ নেতাকর্মীগণ যেমন হত্যা-খুনের শিকার হয়েছেন; তেমনি পথ চলতে গিয়ে ভিন্নমতের কারণেও অনেকে পথহারা হয়ে হারিয়ে গিয়েছেন। অনেকে হারিয়ে গিয়েছেন জীবন-জীবীকার কঠিন সংগ্রাম করতে গিয়ে। কেউ কেউ ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন সুবিধাবাদের হাত ধরে। অতীতে আন্দোলনে যে যতোটুকুই ভূমিকা রাখুন না কেন— জাসদ তাঁদের প্রত্যেকের ভূমিকাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। জাসদ তাঁদের প্রত্যেককে নতশীরে ভালোবাসা জানায়। যাঁরা এখনও বেঁচে আছেন কিন্তু নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন কিংবা অন্য দলে আছেন— তাঁদের সকলের জন্য জাসদের দরজা সকল সময় খোলা। কারোর প্রতি জাসদের কোনো রাগ-ক্ষোভ নেই; কষ্ট-অভিমান থাকলেও থাকতে পারে। জাসদের প্রধান দুটি চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য হলো— (১) অন্যান্য দল যখন পুরো-দল একসাথে মিলেমিশে আপোষের পথে যায় [যেমন ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ ও সিপিবির নেতৃত্বে ৮ দল এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যোগ দেয়], জাসদ-কর্মীগণ তখন যেটাকে ন্যায্য মনে করেন, তার সাথেই থাকেন; বারবার ভাঙন ও দলত্যাগের মধ্য দিয়ে শক্তিক্ষয়ের মতো ঘটনা ঘটলেও গণমানুষের অধিকার আদায়ের কোনো আন্দোলনে এ পর্যন্ত জাসদ কখনো অনুপস্থিত থাকে নি। এটা জাসদের একটি সাংগঠনিক-দুর্বলতাও বটে। আর— (২) এই দলে কাল্ট বা ব্যক্তিপূজার কোনো জায়গা নেই; যাঁরা বঙ্গবন্ধুকে নির্মাণ করেছিলেন, তাঁরা সে বঙ্গবন্ধু ও ক্ষমতার মোহ ছেড়ে ১৯৭২ সালে জাসদ গঠন করেন। তাঁরা আবার তাঁদের একচ্ছত্র নেতা সিরাজুল আলম খানের সব সিদ্ধান্তকেও অন্ধভাবে অনুসরন করেন নি। জাসদ আপোষহীন কর্মীদের দল।
বাইশ.
ফলে আজকাল যাঁরা জাসদের প্রাতিষ্ঠানিক ঐক্য চান, তাঁরা কি ১৯৯৭ সালের ঐক্যের কথা ভুলে গিয়েছেন? দেখেছেন, আসম আবদুর রব কীভাবে তাঁর প্রথম দলত্যাগকে দ্বিতীয়বার অনুসরণ করেছেন? তাই বলি— রাজনৈতিক ঐক্য ছাড়া সাংগঠনিক ঐক্য অর্থহীন; অকার্যকর; এমনকি ক্ষতিকরও বটে!!!
জিয়াউল হক মুক্তা
প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ
কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি
৮ জুলাই ২০২০; ঢাকা।
Leave a Reply