জহুরুল কবীর :
মোঃ আজিজুর রহমান। প্রখ্যত শিল্পী ও সুরকার। পিতা আব্দুল ওয়াহেদ ওমাতা মোহর জান বিবি।পুত্র মোঃ আজমীর হোসেন রাজা ও শরীফ হোসেন রানা ও কন্যা মোছাঃ লাবণী ইয়াসমীন।
শিল্পী ও সুরকার আজিজুর রহমান ১৯৫২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি ভারতে উত্তর চব্বিশ পরগনার গাইঘাটা থানার বিষ্ণুপুর নাগবাড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি, মামা নাট্যশিল্পী গাজী রহিম বক্স’র বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতেন। ভারতের চব্বিশ পারগনা জেলার বিষ্ণুপুর নাগবাড়ি প্রাইমারি স্কুল থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ও বিষ্ণুপুর খাঁঠুরিয়া হাইস্কুলে পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তিনি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলা সোনাবাড়িয়া নিজ পিতৃনিবাসে চলে আসেন এবং কলারোয়া পাইলট হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬৭ সালে কলারোয় পাইলট স্কুল থেকে প্রাইভেট ভাবে মেট্রিকুলেশন ও খুলনা সুন্দরবন কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে আইএসসি পাশ করেন। মোঃ আজিজুর রহমান প্রাইমারি শিক্ষার পাশাপাশি মামা নাট্য শিল্পী রহিম বক্স গাজীর অনুপ্রেরণায় সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন। ভারতের প্রখ্যাত কণ্ঠ শিল্পী উস্তাদ বিমলইন্দু বিশ্বাস কাছে হাতেখড়ি দেন। কিংবদন্তি সংগীত সাধক শ্যামল মিত্রের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা গ্রহণ করেন।পরবর্তিতে কাওয়ালী ঠুংরী সঙ্গীতের সম্রাজ্ঞী আমেনা বেগম ও উস্তাদ ঋষিকেশ ব্যানার্জি (বেহালা বাদক) এর নিকট দীর্ঘকাল সঙ্গীত প্রশিক্ষণ নেন।শিল্পী ও সুরকার মোঃ আজিজুর রহমান ১৯৭৩ সালে সাতক্ষীরা সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “শিল্পীচক্র”-এর তরুণ সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং খুলনা বেতারে নিয়মিত শিল্পী হিসেবে গান গাওয়া শুরু করেন। তিঁনি ১৯৭৩ সালের ২২শে জুন খুলনা বেতারে গীতিকার সায়েলা চৌধুরীর কথায় ও নিজের করা সুরে আধুনিক বাংলা গান “ তুমি আকাশের নীল – আমি শুধুই চেয়ে থাকি” পরিবেশন করেন।১৯৯১ সালে খুলনা বেতার থেকে এনওসি নিয়ে ঢাকা বাংলাদেশ বেতারে নিয়োমিত শিল্পী হিসেবে যোগ দেন।
মোঃ আজিজুর রহমান ১৯৭৩ সালে সাতক্ষীরার প্রখ্যাত গীতিকার সোনালী ব্যাংকের জিএম জনাব শেখ ফজলুর রহমানের লেখা গান “আমার নিজের জ্বালানো দীপের আগুনে একটু জ্বলতে দাও”-এ প্রথম সুরারোপ করেন এবং প্রখ্যাত শিল্পী আব্দুল জব্বার বাংলাদেশ বেতারে পরিবেশন করেন।
এপর্যন্ত তিনি অনেক গুণীজন খ্যাতিমান গীতিকারদের গানে সুরারোপ করেছেন। তারমধ্যে শেখ ফজলুর রহমান, অচিন্ত কুমার ভৌমিক, আব্দুর রশিদ, সাইফুল ইসলাম সরদার, মোহাঃ রেজাউল করিম, অসিত কুমার মিত্র, আ.ব.ম. সালাউদ্দীন, বাসন্তী গমেজ, সিদ্দিক আবু বক্কর, ভারতের প্রখ্যাত গীতিকার হাবিবুর রহমান, মোকাম আলী খান, প্রাণকৃষ্ণ সরকার, প্রমুখ বিখ্যাত গীতিকারের অসংখ্য গানে তিঁনি সুরারোপ করেছেন।
এছাড়া তাঁন সুরারোপিত গানে ভারতের প্রখ্যাত কণ্ঠ শিল্পী হৈমন্তী শুকলা, সুবীরনন্দি, বাংলাদেশ বেতারের নিয়মিত শিল্পী বাসন্তী গমেজ, তৌহিদা আক্তার রাত্রি, আব্দুল জব্বার, সাবরিনা ইয়াসমিন, সঞ্জয় কুমার প্রমুখ শিল্পীগণ সুরকার আজিজুর রহমানের সুরারোপিত গান গেয়েছেন।
শিল্পী ও সুরকার মোঃ আজিজুর রহমান ২০১২ সালে “সর্বভারতীয়া সঙ্গীত একাডেমি এবং সঙ্গীত সংসদ এ্যওয়ার্ড”; ২০০৭ সালে ঢাকায় মাননীয় বিচারপতি হাবিবুর রহমান এর নিকট হতে “অনিন্দ সঙ্গীত সংসদ এ্যাওয়ার্ড” লাভ করেন। এছাড়া ২০১৫ সালে সাতক্ষীরা নজরুল একাডেমি ও ২০১৭ সালে শিল্পী ঐক্য জোট শিল্পী ও সুরকার মোঃ আজিজুর রহমানকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেন।তবে, একাধিকবার জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে আবেদন করা সত্বেও তিঁনি অদ্যাবধি কোন জাতীয় পর্যায়ের সন্মান পান নি।
সম্প্রতি সুরকার মোঃ আজিজুর রহমান মুজিব বর্ষকে সামনে রেখে গীতিকার প্রাণ কৃষ্ণ সরকার রচিত “হাজার বছরের সেরা বাঙালি” নামে দশটি গানের একটি এ্যালবাম তৈরি করেন এবং জয়টিভিতে শিল্পী সাবরিনা ইয়াসমিন প্রমা ও পূজা রানী কর্মকারের পরিবেশন করেন।
শিল্পী ও সুরকার মোঃ আজিজুর রহমান বাবার ইন্তেকালের পর সংসারের হাল ধরেন। ১৯৭৬ সালে খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডে লেখাকার হিসেবে যোগদান করেন পরে ১৯৯২ সালে পদন্নোতি পেয়ে ঢাকা ৭২ গ্রিন রোডের ডিজাইনার অফিসে নকশাকার হিসেবে যোগদান করেন। গত ২০১০ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন।
সঙ্গীতজ্ঞ আজিজুর রহমানের হাতে ৬৮ বছর বয়সে বহু গুণী শিল্পী তৈরি হয়েছেন। তার হাতে গড়া শিল্পীদের মধ্যে চৈতালি মুখুর্জি, বিশ্বনাথ দেবনাথ, সায়মা সুলতানা, তৈহিদা আক্তার রাত্রি, সাবরিনা ইয়ামিন প্রমা, অম্রিতা দত্ত, আমজাদ হোসেন, মাহবুবুর রহমান প্রমুখ শিল্পীরা তার হাতে গড়া একেকটা নক্ষত্র।
শিল্পী আজিজুর রহমান এপর্যন্ত বহু গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। যাদের মধ্যে “ হাজার ভীড়ের মাঝে- কথা সাইফুল ইসলাম সরদার; আমার নিজের জ্বালানো দীপের আগুনে- কথা শেখ ফজলুর রহমান; ওগো নদী জানি তীর ভেঙ্গে তুমি তীর ভেঙ্গে সুখ পাও- কথা অচিন্ত কুমার ভৌমিক; সবাই বোললো মুছে ফেলো সিথীর সিদুর- কথা মোকাম আলি খান উল্লেখযোগ্য।
সদা হাস্যোজ্বল সদালাপী নির্লোভ এই মানুষটি যেন সভ্যতার প্রতিক। কারো কৃতকর্মকে তিনি কখনো ছোট করে দেখেন না। বরং ভূওসি প্রসংশায় তাকে আরও উদ্বুদ্ধ করেন। কেউ কোন কবিতা গান লিখলে তিঁনি স্বপ্রনদিত হয়ে মনের মাধুর্য মিশিয়ে সুর করে থাকেন এবং নিজের কণ্ঠে শ্রোতাদের শোনাতে ভালবাসেন। মিত্রতা প্রেমি মানুষটির যেন শত্রু বলতে কেউ নেই।
২০০৭ সালে এক বিশেষ সংকটময় মূহুর্তে শিল্পী ও সুরকার মোঃ আজিজুর রহমান সাংস্কৃতিক জগত থেকে কিছুটা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার প্রাককালে হাই কোর্টের বিচারপতি ততকালীন জেলা ও দায়রাজজ জনাব আশিষ রঞ্জন দাসের অনুপ্রেরণা সহযোগিতা ও অনুরোধে সঙ্গীত চর্চা অব্যাহত রাখেন।
Leave a Reply