আবুল কাসেম
এটা ছিল জীবনের তৃতীয় পতন। ব্যবসা লাটে উঠেছে। উঠবেইনা কেনো – ব্যবসা চালাতে যে ধৈর্য্য আর অভিজ্ঞতা দরকার, তা আমার ছিলনা কখনো। তাছাড়া এতগুলো টাকা মেরে দিয়ে লাপাত্তা হওয়ার ধকল সইবার ক্ষমতাও ছিলনা আমার। বিশ পেরোনের আগেই পারিবারিকভাবে বিয়ে। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক বালিকা। কয়েকদিনেই বুঝলাম, ছি-কুতকুত আর দড়ি-খেলাই যখন তার প্রিয় কাজ হওয়ার কথা,তখন এই সঙের কাজ, সত্যিই বেমানান এই মিষ্টি বালিকাটির জন্য। আমি তাকে স্বাধীনতা দিলেও রেলস্টেশনে এসে নৌকায় চড়ে ঘুরতে চাওয়া-তো আর হয়না। একদিনতো তার কথা শুনে আমি হতবাক। ’ দিনে দু’শ টাকা বিক্রি হয় দোকানে?’ কোন ধারণা আর চিন্তা থেকে সে এই প্রশ্ন করেছিল, আজো আমি এই প্রশ্নের উত্তর খোজার চেষ্টা করি। একপর্যায়ে সেনাবাহিনী থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া জনৈক ভদ্রলোকের কাছে দোকান বিক্রি করে দিলাম। যে টাকাগুলো পেলাম, সবটাই ভাইকে দিয়ে দিতে হলো। কপর্দকহীন অবস্থায় আবারও পদযাত্রা। চাল কিনলাম বাকিতে। গ্রামে বেশ কিছু জমি-জমা ছিল। পুরোটাই ডুবানো। জলাবদ্ধতা আর নদী ভাঙনে কত জমি-জমাওয়ালা মানুষকে যে ভিখেরি করেছে, তার হিসেব কে জানে। দুর্শ্চিতা দূর করতে কাজে ডুবে যাওয়া প্রয়োজন। ডেল কার্নেগীর এই উক্তি বারবার মনে উকি মারছিল। আধা-শিক্ষিত বেকার তরুণদের আর কিইবা করার আছে, টিউশনি করা ছাড়া। কোথায় যেন পড়েছিলাম, নিজ স্বপ্নের চারা বড় করার সময়ে নামমাত্র মূল্যে অন্যের স্বপ্নবীজ সত্য করার নামই টিউশনি। তবুও বেকারদের একমাত্র অবলম্বন এটা। শুরু করলাম পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রকে দিয়ে। তবে টিউশনি করার সুখস্বপ্ন আমার নিমিষেই কেটে গিয়েছিল, যখন সে বিজ্ঞের মত সব বোঝার ভান করত। অথচ কিছু ধরলে হা করে চেয়ে থাকত। মাঝে মাঝে আবার হাসিও পেত, যখন সে কিছু বুঝলেই হাতে তুড়ি মেরে ‘চন্ট’ বলে চেচিয়ে উঠত। সামান্য আয়ে সংসার যেন আর চলেনা। এমনও হয়েছে দু’টাকায় পঞ্চাশ গ্রাম ডাল কিনে দু’দিন চালাতে হয়েছে। খুবই খারাপ লাগত বালিকা বউটির জন্য। নিজের অসহায়ত্বে মনে হতো লজ্জা পেয়ে পাতা কুকড়িয়ে যাচ্ছে বাড়ির সামনে থাকা পেয়ারা গাছটির। আবারো পড়া-লেখা শুরু করলাম। ছোট বেলা থেকে অত্যন্ত মেধাবী বলে স্বীকৃতি ছিল। ইংরেজিতে অনার্স পড়তাম। তবে জীবন ধ্বংস হয়েছে ছাত্ররাজনীতির কারণে। ছোট বেলা থেকে আমার একটা বৈশিষ্ট ছিল। আমি যা করি-খুবই মনোযোগ দিয়ে করি। পড়তে বসেছি একদিন-এমন সময় আমার বিবাহিতা ছোট বোন বেড়াতে এসে আমাকে ডাকছে। অনেক দিন পর সে বেড়াতে এসেছে। আমি তার ডাকের উত্তরে “হ্যা-হ্যা” করেই যাচ্ছি। অথচ আমার খেয়াল নেই, আমার অতি আদরের ছোট বোন এসেছে। এভাবেই গড়াতে লাগল দিন। সারাদিন বিরামহীন পথচলা আর রাতে ক্লান্তিহীন লেখাপড়া। সামনে বিএসএস পরীক্ষার ফর্ম-ফিল-আপ। সঠিক হিসেব নেই। তবে হাজার চারেকের কম হবেনা। কিভাবে এত টাকা ম্যানেজ করব-বুঝে উঠতে পারছিনা। ধার-কর্জ করাটা ঠিক আমার দিয়ে হয়না। তাছাড়া চাইব-বা কার কাছে। চলার পথে আমার নীতিটা এমন-না থাকে-খাবনা, হাত পেতে রাজভোগ ভক্ষণ, আমার দিয়ে হবেনা। অবশেষে চোখ পড়ল,বউয়ের কানের দুল আর চেইনের ওপর। মুখ কাচু-মাচু করে বলতেই সে খুলে দিল। তবে তার চোখের কোনে ঈষৎ জমা জল আমার বুকে সাগরের বিশাল জলরাশির ধাক্কা দিচ্ছিল। হায়রে বাঙ্গালী নারী,পৃথিবীর শ্রেষ্ট নারী। এরাই পারে,হাড়ির ওপরের খাবার পরিবারের মাঝে সবটুকু বিলিয়ে, তলার তেলকাষ্টে খেয়ে তৃপ্তিতে থাকতে। গহনা বন্ধকের টাকায় ফর্ম-ফিল-আপ করে আসলাম। নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষা শুরু হলো। যশোরে থাকার জায়গা নেই। হোটেলে থাকার পয়সা নেই। অগত্য বাড়ি থেকেই যেতে হলো। দু’একদিন এমন হয়েছে-পরীক্ষা শুরু হওয়ার আধা-ঘন্টা পরে পৌছেছি। দেখতে দেখতে তিন মাস পার। আগামী কাল পরীক্ষার রেজাল্ট। উদ্বেগের জমাটটা ভারী হতে লাগল। যশোরে যাওয়ার টাকা নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম বাসে উঠে ভাড়া দেবনা। দাঁড়িয়ে যাব। সকালে প্রতিবেশিদের কাছে দোয়া চাইতে গেলাম। প্রথমেই বৌদিদের বাড়ি গেলাম। আমি উনাকে বেশ সমীহ করতাম। চালচলনে গম্ভীরতা কিন্তু আচরণে বিনয়ীভাব উনাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছিল। তাছাড়া উনি বড় ছিলেন বলে ছোট সব বোনদের নিজের কাছে রেখে পড়ালেখা শিখিয়ে সুপাত্রে পাত্রস্থ করেছিলেন। চাকরির মধ্যেও বৃদ্ধ মা-বাবার সেবা-যত্নের এতটুকু কমতি ছিলনা তার। বাংলার ঘরে ঘরে এমন মেয়ে জন্মালে কেউ ছেলের আশায় ৪/৫টি মেয়ে জন্ম দিতেন না। আশীর্বাদ চাইতেই , “তোমার জন্য আশীর্বাদ আমার ঠাকুরের ঘরে তোলা, বলতে বলতে ঘরে ঢুকে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট দিয়ে বললেন, এটা রাখো, যশোরে যেতে কাজে লাগবে। কৃতজ্ঞতায় আমার চোখে জ¦ল ছল-ছলিয়ে উঠল। সকালের মিষ্টি রোদ ওই জলে লেগে চিক-চিক করে উঠেছিল কিনা জানিনা। তবে হৃদয়ের গহীনে এই কৃতজ্ঞতা শক্ত পাথরে আকীর্ণ হয়ে রলো। অফিসের সামনে নোটিশ বোর্ডে ফলাফল সাটানো। প্রচণ্ড ভীড়। দেরি না করে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। একপর্যায়ে সুযোগ মিলল রেজাল্ট দেখার। দ্বিতীয় বিভাগের সব রোল তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পেলাম না। এক পর্যায়ে তৃতীয় বিভাগের রোলগুলোও মিলিয়ে নিলাম। কোথাও নেই। পেছনে দাঁড়ানো ফলপ্রার্থীদের চাপে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হলাম। ঘাসের ওপর থপাস করে বসে পড়লাম। মাথাটা পোপো করে ঘুরছিল, নাকি পৃথিবী আমাকে ঘিরে ঘুরছিল, বুঝতে পারলাম না। নিজেকে অপদার্থ আর অসার মনে হতে লাগল। আর মনে পড়তে লাগল স্ত্রীর গহনা আর বৌদির দেয়া ৫০ টাকা। মানতে পারছিলাম না। আবারও উঠে লাইনে দাঁড়িয়ে নোটিশ বোর্ডের কাছে গেলাম। এবার নীচ থেকে দেখতে লাগলাম। তৃতীয় শ্রেণি; নেই। দ্বিতীয় শ্রেণি ; না, তাতেও নেই। হঠাৎ চোখ আটকে গেল নোটিশ বোর্ডে একেবারে ওপরের কোণে। চোখতো ছানা-বড়া! একি! ১০৪৭৬৩-প্রথম বিভাগ। একটাই রোল। আমি কয়েকবার নম্বর মিলিয়ে নিলাম। ঝাপসা প্রিন্টের অস্পষ্ট নম্বর তখন যেন জলজল করে আমার চোখে চোখ রেখে বলছে,দোস্ত,আমি এখানে। সত্যি বলতে কি ৩ লাখ ৮৪ হাজার কি:মি: দুরের ওই চাঁদটা সেদিন মধ্যদুপুরে এসেছিল আমার হাতের মুঠোয়। কোটি কোটি টাকা আমার না থাকলেও এখন বেশ স্বচ্ছলতা রয়েছে আমার। তবুও হৃদয় মানসে শ্রদ্ধার সাথে গেঁথে রয়েছে সেই ৫০ টাকা। বৌদির দেওয়া ৫০ টাকা।
Leave a Reply