গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। এখানে বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার- অর্থনৈতিক ইতিহাস বলে যে, উচ্চতর প্রবৃদ্ধি কখনোই উন্নয়নের সমার্থক নয়, কিংবা উন্নয়ন পরিমাপের জন্য প্রবৃদ্ধিই একমাত্র সূচক নয়; বরং উচ্চতর প্রবৃদ্ধির সমান্তরালে জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ হারে বৃদ্ধি পায় বৈষম্য। বাংলাদেশ এর বাইরে নয়; উচ্চতর প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দেশের রাষ্ট্র-সমাজ-সংস্কৃতিতে মানুষে-মানুষে বৈষম্য বেড়েই চলছে। তবে চাইলে প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে বৈষম্য মোকাবিলা করা সম্ভব।
বৈষম্যের রয়েছে বিবিধ মাত্রা- আয়ের বৈষম্য, সম্পদের বৈষম্য, নারী-পুরুষ বৈষম্য, কেন্দ্রিক ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বৈষম্য, নারী-পুরুষ ও ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর বৈষম্য, গ্রাম ও শহরের বৈষম্য, স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যের বৈষম্য ইত্যাদি। এসব বৈষম্যের মধ্যে আবার রয়েছে ক্রসকাটিং সম্পর্ক; যেমন, আয়ের বৈষম্য প্রভাবিত হতে পারে নারী-পুরুষ বৈষম্য দ্বারা, স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য বৈষম্য প্রভাবিত করতে পারে আয়ের বৈষম্য ইত্যাদি। বহুমাত্রিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সমতার সমাজ নির্মাণ করতে হলে তাৎক্ষণিক এবং আশু বা স্বল্প-মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি বহুমাত্রিক নীতি-কৌশল-কর্মসূচি-প্রকল্প গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। যদিও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণবাদের মতো শোনাবে- আয় বৃদ্ধি পেলে মানুষের ক্ষমতা ও অভিগম্যতা বাড়ে, যা অপরাপর বৈষম্য কমাতে কিছুটা সহায়তা করে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক অনেক সূচকে বাংলাদেশ চমৎকার সাফল্য প্রদর্শন করার সাথে সাথে তীব্রগতিতে নাগরিকদের মধ্যে আয়ের বৈষম্য বাড়ার কথাটি কোনো নিন্দুকের মনগড়া ভাষ্য নয়, বরং সরকারি পরিসংখ্যানের। ২০১০ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত হাউসহোল্ড ইনকাম-এক্সপেনডিচার সার্ভে [এইচআইইএস] বা খানা আয়-ব্যয় জরিপ এবং এর অনুসরণে ২০১৬ সালে পরিচালিত আরও একটি জরিপের তথ্য অনুসারে উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে অব্যাহতভাবে আয়ের বৈষম্য বৃদ্ধির সত্যতা স্বীকার করা হয়েছে। এমনকি সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলেও অব্যাহতভাবে আয়-বৈষম্য বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে।
কোনো দেশের আয়-বৈষম্য কতটা তা পরিমাপ করা হয় জিনি সহগ দিয়ে। জিনি সহগের মান যত কম হয়, আয়-বৈষম্য তত কমে; আর এর মান যত বেশি হয় আয়-বৈষম্য তত বাড়ে। এটা শূন্য হলে বোঝায় যে, দেশের সকলের মধ্যে চরম সমতা বিরাজ করছে; আর এর মান বাড়তে বাড়তে শূন্য দশমিক পাঁচ (০.৫) বা বেশি হলে বোঝায় যে, দেশে আয়-বৈষম্য চরমতম অবস্থায় পৌঁছেছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭৪ সালে দেশে জিনি সহগের মান ছিল ০.২৪। ২০১০ সালে তা বেড়ে হয়েছিল ০.৪৫৮। ২০১৬ সালে তা আরও বেড়ে হয়েছে ০.৪৮৩। ২০১৬ সালে দেশে সবচেয়ে ধনী ১০% পরিবারের হাতে ছিল আয়ের ৩৮.১৬%। এ সময় সবচেয়ে সম্পদশালী ৫% পরিবারে আয় বেড়ে হয়েছে ২৭.৯%, যেখানে সবচেয়ে গরিব ৫% পরিবারে আয় কমে হয়েছে ০.২৩% মাত্র। আয়-বৈষম্যের এ চিত্র শহরের চেয়ে গ্রামে আরও বেশি তীব্র। এ সময় গ্রামাঞ্চলে জিনি সহগ ০.৪৩ থেকে ০.৪৫-এ এবং শহরাঞ্চলে ০.৪৫ থেকে ০.৫-এ বর্ধিত হয়। গবেষকরা জানান যে, বাংলাদেশে যেহেতু গবেষণার সময় ধনী পরিবারগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না, সেহেতু বৈষম্যের সত্যিকার চিত্র আরও ভয়াবহ বলে অনুমান করা অসঙ্গত নয়।
২০১৮ সালে আয়-বৈষম্যের উল্লিখিত চিত্রের ওপর জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি চারটি পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করেছে। প্রথমত, দেশে আয়-বৈষম্য ছয় বছরে অনেক প্রকট হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এ সময়ে সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র ও নাজুক অংশটি আরও দরিদ্র হয়ে উঠেছে। তৃতীয়ত, সবচেয়ে ধনী অংশ দ্রুত আরও সম্পদশালী হয়ে ওঠায় তাদের মধ্যেই আয় আরও কেন্দ্রীভূত হয়েছে এবং চতুর্থত, দারিদ্র্যের মাত্রা গ্রামীণ দরিদ্রদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশি।
আয়-বৈষম্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দেশের অর্থনীতিবিদরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মজুরি বৃদ্ধি ও কর্মসৃজনের মধ্যে সম্পর্কহীনতার কথা বলছেন; প্রবৃদ্ধি বাড়লেও কর্মসৃজন ও প্রকৃত মজুরি বাড়েনি। ফলে দেশ দারিদ্র্য বিমোচনে শ্নথগতি ও অসমতার বৃদ্ধিতে তীব্রগতির অভিজ্ঞতা অর্জন করছে। আমার দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ মনে করে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা ও খাদ্য নিরাপত্তা খাতে কম বরাদ্দের পাশাপাশি সুযোগের অসমতা আর সামগ্রিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিও আয়-বৈষম্য বৃদ্ধির কারণ। অর্থনীতিবিদদের মতে, আর্থিক খাতে ধনীরা বেইলআউট, ঋণ, ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ, কর মওকুফ, ভর্তুকি, লাইসেন্স ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে সহায়তা পান, গরিবরা তা পান না। উপরন্তু গরিবের জন্য যে অপর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকে তাও দুর্নীতির কারণে কমে যায়।
বর্তমান অর্থমন্ত্রী যখন পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন, তিনি বলেছিলেন যে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দের পরও কেন আয়-বৈষম্য বাড়ছে তা খতিয়ে দেখা হবে ও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সে খতিয়ে দেখার খবরের কথা কারও জানা নেই এবং ২০২০-২১ সালের বাজেটেও আয়-বৈষম্য নিরসনে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি; বরং আয়-বৈষম্য বাড়ানোর পদক্ষেপই নেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে সম্পদ আহরণের জন্য প্রত্যক্ষ করের বদলে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা আরও বাড়ানো হয়েছে; সব জনগণের ওপর ভ্যাটের মতো নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা নিয়মিত আয়কর প্রদানকারীদের ওপর ডাবল ট্যাক্সেশনের নামান্তর ও গরিবের সামান্য আয়ের ওপর হিংস্র থাবা বসানোর নামান্তর। এর পরিবর্তে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। করমুক্ত আয়সীমা সামান্য বাড়ানো হলেও নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের জন্য তা নাভিশ্বাসের নামান্তর; করমুক্ত আয়সীমা দশ লাখ টাকা করতে হবে। আগে আয়করের সর্বোচ্চ সীমা ছিল ৩০%, তা ২৫%-এ নামিয়ে এনে ধনীদের আরও ধনী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে; এ প্রস্তাব প্রত্যাহার করে সর্বোচ্চ ৩০% আয়কর আদায়ের বিধান পুনর্বহাল করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ও লুটপাটের অর্থ পুনরুদ্ধার করতে হবে।
বাজেটের আয়ের ক্ষেত্রে উল্লিখিত জনবান্ধব পদক্ষেপের পাশাপাশি ব্যয়ের ক্ষেত্রেও জনবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এরই মধ্য জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি সংসদে বাজেট আলোচনাকালে চার ধরনের ‘সর্বজনীন’ কর্মসূচি গ্রহণ, তার জন্য বর্ধিত বরাদ্দ প্রদান ও বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন; এগুলো হলো- সর্বজনীন শিক্ষা কর্মসূচি, সর্বজনীন স্বাস্থ্য কর্মসূচি, সর্বজনীন সামাজিক-সুরক্ষা কর্মসূচি এবং সর্বজনীন খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি। এবারের বাজেটে এসব খাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দ রুটিন-বৃদ্ধির বাইরে উল্লেখযোগ্য কোনো বরাদ্দ পায়নি। আয়-বৈষম্য বিবেচনায় জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে নগদ সহায়তা বা কার্ড প্রদানের মাধ্যমে তাদের সুরক্ষা বা নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে। জাসদ এসব খাতে বর্ধিত বরাদ্দকে ব্যয় হিসেবে বিবেচনা করে না, বরং বিনিয়োগ হিসেবে দেখে, যা পরে বহুগুণে ফেরত আসে।
বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তীব্রভাবে বিরাজমান আয়-বৈষম্য নিরসনে বাজেটের আয় ও ব্যয় উভয় ক্ষেত্রে সমান্তরাল জনবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করার পাশাপাশি আশু বা স্বল্প-মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি নীতিকাঠামো বিবেচনা করতে হবে; গাছের শেকড় কেটে আগায় জল ঢাললে চলবে না; আশু বা স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপের মধ্যে থাকবে দুর্নীতি-দুঃশাসন-লুটপাট-অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে স্বচ্ছতা-জবাবদিহি-সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপের মধ্যে থাকবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই উন্নয়নের পদক্ষেপ, এবং দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের মধ্যে থাকবে দেশের সংবিধান নির্দেশিত সমাজতান্ত্রিক নীতি-আদর্শের প্রয়োগ- আয়-বৈষম্যসহ সব ধরনের বৈষম্য মোকাবিলার জন্য।
সাধারণ সম্পাদক, সিএসআরএল; জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক
সংগৃহিত: দৈনিক সমকাল
Leave a Reply