পরিবেশ সংক্রান্ত ইস্যু সমূহ দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়ন ইস্যুসমূহের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সাধারণভাবে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়ার উপজাত ফলশ্রæতি, সুতরাং উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন না করে দূষণরোধ করা সম্ভব নয়।
উষ্ণতা বৃদ্ধিকারক গ্যাস (উবগ) নিঃসরনে বাংলাদেশের ভূমিকা নগন্য হওয়া সত্বেও জলবায়ু পরিবর্তন দ্বারা বাংলাদেশই অধিক ক্ষতিগ্রস্থ দেশসমূহের অন্যতম যা আমাদের পরিবেশের জন্য হুমকি¯^রূপ। জলবায়ু পরিবর্তন সৃষ্টি নিমজ্জন বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে “জলবায়ু উদ্বাস্তুতে (পষরসধঃব ৎবভঁমবব) পরিণত করবে। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে নদ-নদী সমূহের অস্থিতিশীলতা সমান্তরালভাবে চলে। নদ-নদীর প্রতি এই উপমহাদেশের দেশসমূহ কর্তৃক অনুসৃত “বেড়ীবাঁধ পন্থা” (পড়ৎফড়হ অঢ়ঢ়ৎড়ধপয) জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট নদ-নদীসমূহের অস্থিতিশীলতার সমস্যাকে আরও তীব্র করছে এবং পলিমাটি ভরনকে বাধাগ্রস্থ করে নিমজ্জনের বিরুদ্ধে এই বর্মটিকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
প্রাকৃতিক সম্পদ বিবেচনায় প্রবাহমান নদীর পানির ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তার পাশাপাশি নদীর অধিকারও ¯^ীকৃত। নদীর অধিকার হচ্ছে পানির পরিবেশগত প্রবাহ (ঊ-ভষড়)ি অক্ষুন্ন রাখা অর্থাৎ যতটুকু প্রবাহ থাকলে তাকে নদী হিসেবে বিবেচনা করা যায়, আর দূষণমুক্ত রাখা। আবহমানকাল ধরে যে প্রবাহ নিয়ে নিভৃতে জনপদ থেকে জনপদে প্রাণের স্পন্দন সঞ্চার করে যাচ্ছে নদী তারও অধিকার আছে বাধাহীনভাবে সেই প্রবাহকে অটুট রাখবার। কিন্তু দখল-দূষণে নির্দয়ভাবে আমরা মাতৃসম নদীগুলোকে ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি। অনুসন্ধান কিংবা বিশেষজ্ঞ দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখলেও নদ-নদীর বিপর্যয়ের কারণ সবার কাছেই স্পষ্ট। কোনরূপ শোধন না করে লম্বা পাইপ বা ড্রেনের মাধ্যমে সোজা নদী কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক জলাশয়ে ফেলে দেওয়া এই বর্জ্যে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকারক রাসায়নিক হেভিমেটাল বহন করছে। যা পুরো ইকোসিস্টেমকে ভেঙ্গে দিচ্ছে। আধুনিক কৃষি উৎপাদনের নামে অসচেতনভাবে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ক্ষেতে দেওয়া হচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে বা সেচের পানির সঙ্গে তাও চলে আসছে নদী বা মুক্ত জলাশয়ে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ, বাস ও চাষযোগ্য ভূমির ¯^ল্পতা নদী ও মুক্তজলাশয়ের দখল দূষণ-দুইকেই ত্বরাšি^ত করছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুশাসন ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অভাবও এই সংকটকে আরো ঘনীভূত করছে। নদীবক্ষে নদী তীরে বিশালাকার সিমেন্ট ও অন্যান্য ভারি শিল্প এখন হরহামেশাই গড়ে উঠছে। প্রতিষ্ঠানগুলো নদী দখল-দূষণে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। বাজার ও গৃহস্থালির বর্জ্য এমনকি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্যও যাচ্ছে নদীতে। ক্রমাগত এসব আগ্রাসনে সর্বংসহা নদী-নদীগুলো আর কতকাল আত্মরক্ষা করবে তা নিয়ে গবেষক-বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগের শেষ নেই। পরিবেশকর্মী হিসেবে আমরাও এই উদ্বেগে শামিল হয়েছি। নদ-নদীর ¯^াভাবিক টিকে থাকার উপর সভ্যতার অস্তিত্ব নির্ভর করে এই ¯^ীকৃত সত্যটি আমরা সবাই বারবার উচ্চকণ্ঠে বলতে চাই।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে নি¤œলিখিত পন্থাগুলো বিবেচনায় আনা যেতে পারে:
(১) পরিবেশ সংরক্ষণকে দেশের উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করতে হবে এবং সে উদ্দেশ্যে সকল উন্নয়ন প্রকল্প ও কার্যক্রমের মধ্যে পরিবেশ বিবেচনাকে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে এবং সে উদ্দেশ্যে সকল উন্নয়ন প্রকল্প ও কার্যক্রমের মধ্যে পরিবেশ বিবেচনাকে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে এবং পরিবেশ সংরক্ষণকে মূল ধারায় পরিণত করতে হবে।
(২) দূষণের উদ্ভব ঘটে ব্যক্তি পর্যায়ে ভোগের নেতিবাচক ‘বহিস্থঃ প্রতিফল’ (ঘবমধঃরাব বীঃবৎহধষরঃু) হিসাবে, সুতরাং ব্যক্তি ভোগের পরিবর্তে সামাজিক ভোগে উত্তরনের মাধ্যমে ‘বহিস্থঃ প্রতিফলকে’ অন্তর্গত বা অন্তস্থ করা সম্ভব এবং দূষণও।
(৩) পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও উপযোগী আইনী কাঠামোর প্রয়োজন। স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে নিজ নিজ এলাকার দূষণ ও পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর তালিকা প্রণয়ন করতে হবে, তালিকাভুক্ত সমস্যাগুলোকে দুই (২) ভাগে ভাগ করতে হবে। এক ভাগে থাকবে সেসব সমস্যা যার নিরসন স্থানীয় উদ্যোগে সম্ভব, আরেক ভাগে থাকবে সেসব সমস্যা যার নিরসনের জন্য জাতীয় পর্যায়ের উদ্যোগ প্রয়োজন এবং শেষোক্ত সমস্যাবলীর ক্ষেত্রে স্থানীয় জনসমাজ কি ধরনের জাতীয় উদ্যোগ প্রয়োজন মনে করে সেটাও লিপিবদ্ধ করতে হবে।
(৪) জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুর্নাবসনের জন্য প্রয়োজনীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা (প্রতিবেশি দেশ সমূহ) নিশ্চিত করতে হবে এবং বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ইস্যুতে সর্বাপেক্ষা ঝুঁকিপূর্ণ দেশ সমূহ এবং এ-৭৭ তে অন্তর্ভূক্ত সর্বাধিক অনুন্নত দেশসমূহের নেতৃত্ব দিতে হবে।
(৫) শিল্প বর্জ্য দ্বারা ভূপৃষ্ঠস্থ পানির দূষণ রোধের উদ্দেশ্যে জরুরী ভিত্তিতে নদী-তীরবর্তী সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য শোধন ব্যবস্থা (ঊঞচ) এর স্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।
(৬) উন্নত দেশ সমূহের বিভিন্ন নগর যেমন হলান্ডের আমস্ট্রারডাম এবং ইতালির ভেনিস খালের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পাশ্ববর্তী নদীগুলোর সাথে শহরের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ট করেছে ঠিক তেমনি ব্যবস্থাপনা আমাদের দেশেও অনুসরণ করা যেতে পারে; পাশিপাশি নদ-নদীর প্রতি “উমুক্ত পন্থা” অনুসরণের মাধ্যমে শহরের সাথে পাশ্ববর্তী নদ-নদীর সম্পর্ক বাড়াতে হবে। প্রয়োজনবোধে নতুন খাল খনন করতে হবে।
(৭) নদী-নালা, খাল বিল ও অন্যান্য জলাভূমিকে সকল প্রকার অবৈধ ও অন্যান্য দখলমুক্ত করার জন্য সরকারকে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।
(৮) সর্বোপরি তৃণমূল পর্যায়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে নিজ নিজ এলাকায় পরিবেশ ও নদী রক্ষার লক্ষ্যে সংঘটিত ও সংঘবদ্ধ হতে হবে।
(৯) কৃষির সূত্রে সংঘটিত ভূপৃষ্ঠস্থ পানির রাসায়নিক দূষণ কমানোর উদ্দেশ্যে কৃষিতে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ঔষধের উপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। এ উদ্দেশ্যে দানাদার পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ, সমšি^ত উদ্ভিদ পুষ্টি ব্যবস্থাপনা, সমন্ধিত কীট পতংঙ্গ নিরোধ ব্যবস্থাপনা এবং জৈব চাষাবাদ ইত্যাদিকে উৎসাহিত করতে হবে।
(১০) নদ-নদীর সীমানা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে শুকনো মৌসুমের প্রবাহের উপর নির্ভর না করে বর্ষাকালের পূর্ণ প্রবাহের উপর নির্ভর করতে হবে এবং এক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত উপাত্ত এবং পং (পধফধংঃৎধষ ংবৎাবৎ) ভূমি জরিপের উপর নির্ভর করতে হবে এবং সঠিকভাবে সীমানা চিহ্নিত করার পর এই সীমাকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার জন্য উপযোগী কাঠামো নির্মাণ এবং অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে এই সীমা লংঘন করে নদী দখল করা প্রতিহত করা যায়; তবে সীমা নিশ্চিতকারী কাঠামোকে এমন হতে হবে যাতে তা নদীখাত এবং নদীর প্লাবন ভূমির মধ্যে পানির চলাচলকে কোনভাবে বাধাগ্রস্থ না করে।
পরিশেষে বলতে পানি কেন্দ্রিক সুষ্ঠুব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে স্থানীয়, জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে শক্তিশালী জনমত গড়ে তোলার মাধ্যমে বাংলাদেশের সরকারী কাঠামোসমূহকে জনগণকেন্দ্রিক চিন্তায় আবৃত করা দরকার। তবেই নদী বান্ধব, পরিবেশ বান্ধব বাংলাদেশকে, আমাদের অস্তিত্বকে আমরা ফিরে পাবো।
(মনোয়ার হোসেন রনি)
কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ও
ঢাকা বিভাগীয় সমš^য়কারী
বাংলাদেশ নদী বাচাঁও আন্দোলন
এবং
আহবায়ক
তুরাগ বাচাঁও আন্দোলন।
মোবাইল নং- ০১৭৩৪৫০৪০৩০
E-mail: ronee_r3@yahoo.com
Leave a Reply