জন্মদিন: বীরকন্যা শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার-এর শেষ বিবৃতি

শহীদ প্রীতিলতার পোস্ট মর্টেম করার সময়ে তাঁর সামরিক পোশাকের মধ্যে নিজ হাতে লেখা একটি বিবৃতি বের হয়ে আসে। অত্যন্ত যত্নে তিনি এটিকে অন্য একটি কাগজে মুড়ে পোশাকের ভিতরে রেখে দিয়েছিলেন। এটি বেশ বড়সড় একটি বিবৃতি। বেশ ভেবেচিন্তেই তিনি বিবৃতিটি লিখেছিলেন। দেখিয়েছিলেন তিনি এটি মাস্টারদা সূর্যসেনকে। সূর্যসেন পড়ে অনুমোদনও দিয়েছিলেন। এই বিবৃতিটি পড়লেই বোঝা যায় যে, বীরকন্যা প্রীতিলতা জানতেন- এই আক্রমণের পরে তাঁর জীবিত ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। সে কারণেই শেষ লাইনে তিনি লিখেছিলেন-
‘এই আশা লইয়াই আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।’

বিবৃতিটি সরকারি পক্ষ আদালতে হাজির করেছিল। পুরো বিবৃতিটি ~

আমি বিধিপূর্বক ঘোষণা করিতেছি, যে প্রতিষ্ঠান উচ্চ আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া, অত্যাচারের স্বার্থসাধনে নিয়োজিত সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ সাধন করিয়া আমার মাতৃভূমি ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তন করিতে ইচ্ছুক, আমি সেই ভারতীয় রিপাবলিকান আর্মির চট্টগ্রাম শাখার একজন সদস্য।

এই বিখ্যাত ‘চট্টগ্রাম শাখা’ দেশের যুবকদের দেশপ্রেমের নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ করিয়াছে। স্মরণীয় ১৯৩০-এর ১৮ এপ্রিল এবং উহার পরবর্তী পবিত্র জালালাবাদ ও পরে কালারপুল, ফেনী, ঢাকা, কুমিল্লা, চন্দন নগর ও ধলঘাটের বিরোচিত কার্যসমূহই ভারতীয় মুক্তিকামী বিদ্রোহীদের মনে এক নূতন প্রেরণা জাগাইয়া তুলিয়াছে।

আমরা দেশের মুক্তির জন্য এই সশস্ত্র যুদ্ধ করিতেছি। অদ্যকার পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি অংশ।

ব্রিটিশরা জোরপূর্বক আমাদের স্বাধীনতা ছিনাইয়া লইয়াছে। ভারতের কোটি কোটি নরনারীর রক্তশোষণ করিয়া তাহারা দেশে নিদারুণ দুর্দশার সৃষ্টি করিয়াছে। তাহারাই আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধ্বংসের এবং সকল অধঃপতনের একমাত্র কারণ। সুতরাং, তাহারাই আমাদের একমাত্র অন্তরায়। যদিও মানুষের জীবন সংহার করা অন্যায়, তবু বাধ্য হইয়া বড় বড় সরকারি কর্মচারীর ও ইংরেজদের জীবন সংহার করিতে আমরা অস্ত্রধারণ করিয়াছি। মুক্তিপথের যে কোনো বাধা বা অন্তরায় যে কোনো উপায়ে দূর করার জন্য আমরা সংগ্রাম করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

আমাদের দলের মহামান্য ও পূজনীয় নেতা মাস্টারদা অদ্যকার এই সশস্ত্র অভিযানে যোগ দিবার জন্য যখন আমাকে ডাক দিলেন, তখন আমি নিজেকে যথেষ্ট সৌভাগ্যবতী মনে করিয়াছিলাম। মনে হইল, এতদিনে আমার বহু প্রত্যাশিত অভীষ্ট সিদ্ধ হইল এবং সম্পূর্ণ দায়িত্ব লইয়া আমি এই কর্তব্যভার গ্রহণ করিলাম। এই উন্নত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতৃত্ব যখন আমার মতো একটি মেয়েকে এই গুরুভার অর্পণ করেন, তখন এতগুলি কর্মঠ ও যোগ্যতর ভাইয়েরা বর্তমান থাকিতে অভিযানে নেতৃত্বের ব্যাপার একজন ভগিনীর উপর কেন ন্যস্ত হইবে, এই বলিয়া আমি আপত্তি জানাইলাম এবং একজন সাধারণ কর্মী হিসাবে ঐ কাজে যাইতে চাহিলাম।

কিন্তু আমি পরে পূজ্য নেতার আদেশ শিরোধার্য করিয়া লইলাম।

আমি মনে করি যে, আমি দেশবাসীর নিকট আমার কাজের কৈফিয়ৎ দিতে বাধ্য। দুর্ভাগ্যবশত এখনো হয়তো আমার প্রিয় দেশবাসীর মধ্যে এমনও অনেকে আছেন, যাঁহারা বলিবেন যে, ভারতীয় নারীত্বের ঊর্ধ্বতন আদর্শে লালিত একটি নারী কি করিয়া নরহত্যার মতো এই ভীষণ হিংস্র কাজে লিপ্ত হইল।

দেশের মুক্তি-সংগ্রামে নারী ও পুরুষের পার্থক্য আমাকে ব্যথিত করিয়াছিল। যদি আমাদের ভাইয়েরা মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হইতে পারে, আমরা ভগিনীরা কেন উহা পারিব না? ইতিহাসে অনেক উদাহরণ আছে, রাজপুত রমণীরা অসীম সাহসের সহিত রণাঙ্গনে যুদ্ধ করিতেন এবং স্বদেশের স্বাধীনতা ও নারীত্বের মর্যাদা রক্ষার জন্য তাহারা শত্রুর প্রাণ-সংহার করিতে কিছুমাত্র দ্বিধা করিতেন না। ইতিহাসের পৃষ্ঠা এইরূপ কত নারীর বীরত্বগাথায় পূর্ণ। তবে কেন আমরা, আজিকার ভারতীয় নারীরা বিদেশির দাসত্ব শৃঙ্খল হইতে নিজের দেশকে পুনরুদ্ধার করিবার জন্য এই মহান যুদ্ধে যোগদান করিব না? যদি বোনেরা ভাইদের সঙ্গে কংগ্রেসের সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিতে পারে, তবে সশস্ত্র বিদ্রোহে যোগদানে তাহাদের বাধা কি? সশস্ত্র বিদ্রোহে অন্য দেশের বহু নারী যোগদান করিয়াছে, তবে কেন ভারতীয় নারীরা বিপ্লবের এই পন্থাকে অন্যায় বলিয়া মনে করিবে?

নারীরা আজ কঠোর সংকল্প নিয়াছে যে, আমার দেশের ভগিনীরা আজ নিজেকে দুর্বল মনে করিবেন না। সশস্ত্র ভারতীয় নারী সহস্র বিপদ ও বাধাকে চূর্ণ করিয়া এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করিবেন এবং তাহার জন্য নিজেকে তৈয়ার করিবেন এই আশা লইয়াই আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।

(স্বাক্ষর)
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।

( Ziaul Hoque Mukta এর ফেসবুক থেকে

[মনিরুজ্জামান খানের পোস্ট। পড়ুন— নিজেদের বিপ্লবী ইতিহাস জানুন। ধন্যবাদ।])

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *