সনৎকুমার সাহা
তাঁর জন্মশতবর্ষ-সূচনালগ্নে বঙ্গবন্ধুকে আমাদের কৃতজ্ঞ স্মরণ। তাঁর নেতৃত্বের প্রেরণাই সম্ভব করে স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। ত্যাগের মহিমায় তা উজ্জ্বল। গণমানুষের চেতনায় তার ব্যাপ্তি এবং সর্বতোভাবে নৈর্ব্যক্তিক পরার্থকামনায় তা সংহত। তবে তাঁকেও মাড়াতে হয়েছে অভিজ্ঞতার কাঁটা-বিছানো পথ। হ্যাঁ-নার দ্বন্দ্বের পর্যায়ক্রমিক বহুমুখী বিস্তার, পরস্পরের সংস্রব ও সংঘাত – এসব এড়িয়ে নয়, বরং তাদের সঙ্গে জড়িয়ে থেকে সাহসের সঙ্গে লড়াই করে ঠেকে শিখে বাস্তবে ভালো-মন্দের বহুমাত্রিক চেহারায় স্থান-কাল-পাত্রের স্বরূপ চিনে নিতে নিতে সমগ্রকে ধরবার ও তার কল্যাণময় রূপ খোঁজার সাহসী পদক্ষেপে তাঁর ক্রমাগত অগ্রসর হওয়া। ভয় পাননি। ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ – জীবন দিয়ে তিনি এই মূল্যমানেই আস্থা রেখে গেছেন। দাম দিতে হয়েছে চূড়ান্ত। ব্যক্তির মাপে নয়, গোটা বাঙালি বাস্তবতার মাপে। তাঁকে নিয়ে আমাদের অর্জনের গুরুত্বও বিপরীত দিক থেকে এমন দেখায়। ‘আমার জীবনে লভিয়া জীবন জাগোরে সকল দেশ’ – যদি আগামীতে এই জেগে ওঠা তাঁর স্বপ্ন-কল্পনার সার্থকতা খোঁজে, তবেই তাঁকে মনে করা, মনে রাখা অর্থবহ হয়। অবশ্য খুরের ধারের মতো পথ দুর্গম। কখনো কখনো সামনে কেবল বৃহৎ অনিশ্চয়, অথবা, নিশ্চিত আত্মগ্লানির মনোহর মসৃণ সোপান। মুখোমুখি হবার দায় এখন, এবং ভবিষ্যতের সব ‘এখন’ এই বাংলার মনুষ্যপদবাচ্য প্রতিটি সচেতন-সমর্থ জনের। তিনি যে বলিষ্ঠ ইঙ্গিত রেখে গেছেন তাঁর অকালছিন্ন জীবনসংগ্রামে, তাতে মিলতে পারে পথের সঞ্চয়। স্থান ও কাল বহুমুখী সম্ভাবনার দৃশ্য রচনা করে চলে এগোবার কথা ভাবতে পারে সংশ্লিষ্ট মানবসমুদয়। তাদের কাছে তাঁর কীর্তিকথা তাই বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। আমাদের আত্মস্বরূপ বোঝার জন্যেও জরুরি।
তবে কোনো মহামানব হবার বায়না তিনি মেটান না। ‘যে আছে মাটির কাছাকাছি’, এমন এক মানুষই ছিলেন তিনি। তাদের ভেতর থেকে, তাঁর মতো অসংখ্যজনের জীবনের স্পন্দনে সাড়া দিয়ে, তাদের মনে সাড়া জাগিয়ে এক অখ্যাতজনের মতো তাঁর বেড়ে ওঠা। একসময় প্রবাদপুরুষে পরিণত হওয়া। তা তাঁকে গণবিচ্ছিন্ন করেনি। বরং গণমানুষের জীবনভাবনায় একাত্ম হয়ে তাদের সঙ্গে অভিন্নতার যোগসূত্র রচনার স্বতঃস্ফূর্ততা নির্বিশেষ হবার বিরল বৈশিষ্ট্য তাঁকে দিয়েছে। তাঁকে বোঝার জন্যে তাঁর কালের মাত্রাটাও আমাদের মাথায় রাখা জরুরি। এবং সবটাই নিরাসক্ত মনে। যা ঘটে, তাই বিধিলিপি, অদৃষ্টের কাছে এমন আত্মসমর্পণে কোনো গৌরব নেই, যথেষ্ট আত্মাবমাননা আছে। প্রতিটি মুহূর্ত অসংখ্য সম্ভাবনা তুলে ধরে। জনসমুদয়ের পরস্পরবিচ্ছিন্ন, সংযুক্ত, একক, বহুদলীয়, বহুমুখী উদ্যোগ ও কার্যপরম্পরা সেসবের পরিণামে বিভিন্ন জীবনপ্রবাহে গতি আনে, প্রকৃতির স্বরূপও বস্তুগ্রাহ্য আকার পায়। পেয়ে চলে অবিরাম। তারই প্রেক্ষাপটে কোনো ব্যক্তিপ্রতিভা যদি অসামান্যের রাজটীকা মাথায় নিয়ে বিকশিত হয় অথবা বিধ্বস্ত হয় সমূহ বিনাশে, তবে তাকে ওই সম্ভাবনারাশির একটির ঘটনারূপ বলে মেনে নিই; যদিও পরিণামে তা থেকে আরো বহুবিচিত্র সম্ভাবনা গজাতে পারে। ব্যাপারটি দাবা খেলায় প্রতিপক্ষের সামনে পরপর দান দেবার মতো। বিপুল ব্যক্তিপ্রতিভা অবশ্য কখনো কখনো অনিশ্চয়তার যোগসাজশেই মাথা তুলে এগিয়ে এসে দেশ-কালের আপন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে প্রবলভাবে নিজের অনপনেয় ছাপ রেখে যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট মানবসমুদয়ের ইতিহাসের গতিপথও হয়তো তাতে বদলে যায়। কিন্তু এর সবটাই বহু মানুষের সমূহ আচরণ সঙ্গে করে তাতে বাড়তি উপাদানের জোগান দিয়ে। ধ্বংস বা সৃষ্টি, অনুরাগ বা বিরাগ, উন্নয়ন বা অবনয়ন, অথবা সবগুলোর মিশ্রণ মিশে থাকে মানবযাত্রায় – এককে এবং সমষ্টিতেও। Ôwhole centuries of follies and noise and sinÕ যেমন অনিঃশেষ, তেমনি ভালোবাসা, তৃপ্তি, আনন্দও। সব মিলিয়ে অবশ্য মানুষ আপন সক্ষমতার সম্ভাবনাকে ক্রমাগত প্রসারিতই করে। যদিও সংক্রান্তি পুরুষ বা মানবীরও বস্তুসিদ্ধ আবির্ভাব ঘটে কখনো কখনো অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকর্মের বিস্ফোরণে। ইতিহাসযাত্রায় ইতিহাসস্রষ্টা মানব-মানবীদেরও আমরা পথের বাঁকে বাঁকে এইভাবে পাই। এবং সবটাই বিরতিহীন চলমানতায় দুর্জ্ঞেয় কেলাসনের পরিণাম। যদিও এও বাস্তব। এই চলমানতাকে যদি কোনো আচার-বিচারের ছকে-বাঁধা-খোপে পুরে তাতে চিরকালের ছাপ মেরে দিতে চাই, তবে তাতেই ঘটে নিশ্চয়তাবিলাসী সিদ্ধান্তবাগিশদের সর্বজ্ঞ সাজার ভ্রান্তি। তার খেসারত দিতে হতে পারে ওই খোপে আঁটা সব মানুষকেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
এই কথাগুলো মাথায় রেখে বঙ্গবন্ধুর কীর্তিকথায় আবার নজর দিই। বাঙালি, বাংলাদেশ – এই ধারণা বা প্রত্যয়গুলোও অনিবার্যত সেখানে প্রাসঙ্গিক।
দুই
তাঁর যাত্রা শুরুতেই ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে নয়। এটি তাঁর অর্জন। ক্রান্তিলগ্নে এই ভূখণ্ডে জনগণের চূড়ান্ত সংগ্রামের সূচনায়। জীবন বাজি রেখে সব ভয় তুচ্ছ করে অসীম মনোবল নিয়ে একাগ্র সাধনায় এগিয়ে যাবার অনমনীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দেশবাসীর প্রকাশ্য স্বতঃস্ফূর্ত সর্বসম্মত ঐকান্তিক ঘোষণায় তিনি পান এই পরিচয়। জন্মসূত্রে পাওয়া নামকে তা ছাপিয়ে যায়। যদিও ওই শেখ মুজিবুর রহমান তলিয়ে যায় না। নিত্যদিনের চলায় পথের বাঁকে বাঁকে নিজেকে নিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে আঘাত-প্রত্যাঘাতের সব চিহ্ন গায়ে নির্বিকার ফুটিয়ে তুলে তা ক্রমাগত উজ্জ্বল হয়। তিনি কিছুই গোপন করেন না। অতিমানব হন না। বরং মানুষের সীমানায় ধ্যান-ধারণার বৃত্তে থেকে, আবার বৃত্ত ভেঙে সহজ সরলতায় সাহসী পা ফেলে সামনে এগিয়ে চলেন। ‘গোপন হিংসাকপট রাত্রিচ্ছায়ে’ হানা দিয়ে এই চলার ইতি টেনেছে। তাঁর দীপ্তি কিন্তু ম্লান হয় না। যদিও সাপ-লুডো খেলার মতো পথে ওঠা-পড়ার শেষ নেই। বাস্তব ভোল পালটায়। বহুমুখী স্বার্থবাহী মতলবের শাখা-প্রশাখা নানা দিকে ছড়ায়। তারপরেও যে ধ্রুবপদ তাঁর জীবনসংগ্রামে উদ্ভাসিত হয়, জীবনের অনিবার্য দ্বান্দ্বিকতায় তা এক প্রেরণার উৎস হয়ে থাকে। বহু পথ ঘুরে ঘটনার দৃশ্যপট বদলে যাওয়া সত্ত্বেও। ‘বঙ্গবন্ধু’ – নামাবলি গায়ে পথ-সংকীর্তন অথবা ক্ষমতাকেন্দ্রে অসহিষ্ণু দাপট কিন্তু তাঁর মহিমা বাড়ায় না। বরং কী করে শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন, এই অভিযাত্রার অনুসরণেই তাঁর অনন্য বিকাশ ধরা পড়ে। বাংলাদেশ তার যৌক্তিক ও ভাবগত সত্তার স্বরূপ খুঁজে পায়।
জন্ম তাঁর এই বাংলায় ফরিদপুরের অতিসাধারণ এক গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায়।
একই রকম আর পাঁচটা গ্রামের মতো বিশেষত্বহীন। চেনা-জানা-মাখামাখি-ঝগড়াঝাঁটি সব গায়ে-গায়ে লাগা। গতানুগতিক জমিজমা-ব্যবসাপত্র নিয়ে কোনো পরিবার সম্পন্ন, কোনোটা বা পড়তি। তার ভেতরেই আত্মীয়তা-কুটুম্বিতার জাল। শেখ পরিবার তুলনায় বড় – লতায়পাতায় ছড়ানো। এমনটি অবশ্য কোনো ব্যতিক্রম নয়। সব গ্রামেই এমন। সাম্প্রদায়িক দূরত্ব ছিল। অনেকটা চাক বেঁধে। তবে বাইরে মেলামেশা সাধারণত অবাধ। যদিও অন্তঃপুরে সংস্কারের গণ্ডি ছিল দুর্লঙ্ঘ্য। কারো কারো মনোবেদনার সংগত কারণ। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠত সামান্যই। কারণ এমনই ছিল দেশাচার। অবশ্য বিভেদের সচেতনতা একটু একটু করে দানা বাঁধতে শুরু করেছে তাঁর শৈশবেই। তা বাইরে থেকে আমদানি। নগরজীবনে স্বার্থের দ্বান্দ্বিকতা ছায়া ফেলে গ্রামে। গণমানসে তার দখল প্রসারিত। কারণ তফাৎগুলো মৌরসিপাট্টায় চলে আসে তর্কাতীত ও প্রতিকারহীন। যদিও সবটাই অমূলক।
উনিশ শতকের বাংলায় হিন্দু গৌরবের পুনর্জাগরণের অহংকার, বিশেষ করে, মুষ্টিমেয় শিক্ষিত সমাজে বেশ জাঁকিয়ে বসতে শুরু করে। ব্রিটিশ শাসনে প্রভুশক্তির তুলনায় নিজেদের ঐতিহ্য যে ফেলনা নয়, এটা জানার ও দেখাবার তাগিদটা যেন বাড়ে। য়োরোপীয় জ্ঞানকাণ্ডের সঙ্গে পরিচয় ও রেনেসাঁসের ইতিহাস তাতে প্রেরণা জোগায়। য়োরোপীয় পণ্ডিতসমাজের বিশেষ বিশেষ ঘরানায় তার অনুমোদনও জোটে। সব মিলিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবোধের একটা ভাবমূর্তি আকার পেতে শুরু করে, যদিও কেউ ভেবে দেখে না, স্ববিরোধ তার থেকে যায় গোড়াতেই। প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন কীর্তি শ্লাঘনীয় হলেও তাকে হিন্দু, অথবা, ঘটনাপরম্পরায়, আর্য পরিচয়ে তুলে ধরা সংজ্ঞা নির্ণয়ে এক গুরুতর ভ্রান্তিকেই প্রশ্রয় দেয়। এ যেন শূন্যের ওপর প্রাসাদ নির্মাণ। অথচ, প্রাসঙ্গিক সময়ে তারই ছটায় দিগ্বিদিকে তুমুল আলোড়ন। প্রাচীন ওই কীর্তি অবশ্যই অতুলনীয়। কিন্তু তাতে হিন্দুত্বের বড়াই অমার্জনীয় অপরাধ। ওই অবদানের ঐশ্বর্যে, অথবা ওই সময়ের জীবনভাবনায় বা জীবনযাপনের নির্দেশনায় কোথাও ‘হিন্দু’ শব্দের অস্তিত্ব নেই। না আছে কোনো শাস্ত্রে, না শিল্পে বা সাহিত্যে। আসলে ওটা ধার করা শব্দ। ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে আরব সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুরাজ দাহিরকে পরাজিত করে এ-ভূখণ্ডে প্রথম তাঁদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।
‘স’-এর উচ্চারণ ওই বিদেশি ভাষায় না থাকায় তাঁরা সিন্ধু নদের এপারে সবাইকে বলেন হিন্দু। তখন থেকে এই শব্দের আত্তীকরণ। একাদশ শতকের প্রথম ভাগে, ১০৩১ খ্রিষ্টাব্দে, আল-বেরুণী যে বিখ্যাত বই রচনা শেষ করেন (আবু মহামেদ হাবিবুল্লাহ্র অনুবাদে নাম ভারততত্ত্ব), তাতেও হিন্দে বা হিন্দুদের আচার, বিচার, ধর্মাচরণ, দর্শন ইত্যাদি নিয়েই তাঁর কারবার। ওই সিন্ধু নদকে প্রারম্ভিক রেখা ধরে আরো আগে একই কারণে গ্রিক অভিযাত্রীরা তাকে বলে ইন্ডাস। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের গোড়ার দিকে উপমহাদেশের প্রথম সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালে গ্রিক রাষ্ট্রদূত ও পরিব্রাজক মেগাস্থেনেস তাঁর অভিজ্ঞতার যে-বর্ণনা রেখে যান, তার নাম ‘ইন্ডিকা’। ‘হিন্দু’ বা ‘ইন্ডিয়া’, কোনোটিই ভেতর থেকে গজিয়ে ওঠা পরিচয় নয়। এবং দুটোই বৈচিত্র্যনির্ভর। বাইরের অভিঘাত আত্মস্থ করা তার ঐতিহাসিক নিয়তি। পরিচয় পৌরাণিকও হতে পারে। যেমন, ‘ভারত’। কিংবদন্তির দুষ্মন্ত-শকুন্তলা-পুত্র ভরতের ধারাবাহিকতায় যে-মানবধারা, তাকে, এবং তার আবাসের বিস্তারকে এই নাম চেনায়। আজকের, অথবা, আরো নির্দিষ্ট করে বলা যায়, বিশ শতকের ব্রিটিশ ভারতের সীমা তা ছাড়িয়ে যায়। তার রাজনৈতিক মানচিত্র, ভাঙা-গড়ার পালা কিন্তু চলে অবিরাম। তাতে মিশ্রণ অনিবার্য। ভূপ্রকৃতি, জীবনচর্চা, সংস্কৃতি, এসব নিয়ে একটা কেন্দ্রীয় আকর্ষণ অবশ্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীনিরপেক্ষভাবে কাজ করে চলে। কালের বৃহত্তর পরিসরে কেন্দ্রও সরে সরে যায়। ধারাবাহিকতার রেশ থেকে যায় যদিও। ছয়শো খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে যে ষোড়শ মহাজনপদের উল্লেখ পাই, তাতে গান্ধার ও কম্বোজ ছিল হিন্দুকুশ পেরিয়ে আজকের আফগানিস্তান ও মধ্য-এশিয়া ভূখণ্ডে। পরে শক-হুনদলের অভিযানও ওইসব অঞ্চল থেকে। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে কুশান সম্রাট কনিষ্কর রাজধানী ছিল পুরুশপুর বা আজকের পেশোয়ারে। তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তার বর্তমান পাকিস্তানের প্রায় সবটাই গ্রাস করে রাজস্থানেও প্রসারিত হয়েছিল। গ্রিক ও পারসিক সংযোগের ধারাবাহিকতা পাই আলেকজান্ডারের অভিযানের সময় থেকে। তুর্কি মোগল ও আরব সংযোগ অবাধ হয় পরে দ্বাদশ শতকের সমাপ্তি লগ্নে। সেটিও যে নির্দ্বান্দ্বিক ছিল, তা নয়। পাঠান-মোগল পারস্পরিক বিদ্বেষ নির্মমতম হানাহানি ডেকে আনে বারবার। এছাড়া ১৩৯৮ সালে সমরখন্দ থেকে তৈমুর লং, ১৭৩৯-এ পারস্য থেকে নাদির শাহ ও পরপরই ১৭৪৬-১৭৬৩-র ভেতর পাঁচবার আফগান যুদ্ধবাজ আহমদ শাহ আবদালি দিল্লি দখল করে হত্যা ও লুণ্ঠন শেষে আপন আপন দেশে ফিরে যান। তুর্কো-আফগান সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি (১২৯৬-১৩১৬), অভিবাসী মোগলরা ষড়যন্ত্র করছে, এই সন্দেহবশে গণহত্যা চালিয়ে তাদের সমূলে উৎপাটিত করেন।
তবে প্রায় চার হাজার বছরের ধারাবাহিকতায় জানা-অজানা বিবিধ সংযোগরেখা ধরে এই ভূখণ্ডের মানববসতি আলগা সুতোয় বাঁধা এক ধরনের পরিচিতি পেয়ে যায় – যদিও তা বহু বৈচিত্র্যে, বহু বৈপরীত্যে ভরা। রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে যেমন, তেমন রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অতিক্রম করেও। জীবনযাপন প্রণালি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, পছন্দ-অপছন্দ, নৈকট্য-দূরত্ব, এসব তার অবয়বের নানা দিক, নানা মাত্রা। অস্বীকার করা যায় না, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পর্ব তাকে কার্যকরভাবে চেনায়। যদিও তা কোনো প্রামাণ্য বা অনুমোদিত চিরকালীন বাস্তবতা নয়। প্রবহমান মানবসত্যই তেমনটির অন্তরায়। তাছাড়া, কী দেখতে চাই, কেমন দেখতে চাই, কে দেখে, এগুলোর ভূমিকাও উপেক্ষণীয় নয়। ভিনসেন্ট স্মিথের ইতিহাস সাজানোয় পর্ব বিভাগ, বা ম্যাক্স মুলারের এখানে আর্য সভ্যতার উঁচুদরের বিকাশ দেখে প্রশংসায় গদগদ হওয়া, এর কোনোটিই চূড়ান্ত বিচারে যথার্থ নয়। অনেক ক্ষতির বীজও তারা কালের গর্ভে বুনে দেয়। হিন্দু ও ভারত সমার্থক হলে ওই প্রবাহের অর্থবহ বিচার হয়তো সম্ভব। তার আবেগঘন উচ্চারণ শুনি ইকবালের কণ্ঠে ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা হিন্দুসিতা হামারা – ।’ কিন্তু হিন্দু ধর্ম বলে বা হিন্দু সংস্কৃতি বলে কোথাও আলাদা গরিমা আরোপ করলে তাতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। ইতিহাসচর্চাও সংকীর্ণতায় ভোগে। একই রকম কেউ যদি যুদ্ধজয়ের ঐতিহ্যে বাড়তি গৌরব দাবি করে বসে। গণমানুষের ধারার আংশিক পরিচয় হয়তো তাতে মেলে।
ইতিহাসের ধারায় দূরতর অতীতে উপমহাদেশের প্রায় সমস্তটায় সাম্রাজ্যের বিস্তার দেখি সম্রাট অশোক, আলাউদ্দিন খিলজি ও বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সময়। কলিঙ্গ ছাড়া আর কোথাও অশোক যুদ্ধাভিযান করেননি। দাক্ষিণাত্যে বা সিংহলে তিনি বুদ্ধবাণী পৌঁছে দিয়ে শ্রদ্ধা ও সম্মান অর্জন করেন। তারপরেও দক্ষিণে কেরালা অঞ্চল তাঁর ধর্মাভিযানের বাইরে থেকে যায়। একই রকম আলাউদ্দিন খিলজি ও আওরঙ্গজেবও দক্ষিণ ভারতের কিছু প্রান্তীয় ভূখণ্ডে পা ফেলেননি। তবে দুজনের বেলাতেই সাম্রাজ্যবিস্তার তার ধ্বংসেরও কারণ। আলাউদ্দিন খিলজি রাজ্যজয় শেষ করে দিল্লি ফিরে আসতে আসতেই দখল প্রায় সবটাই তাঁর হাতছাড়া হয়। আর আওরঙ্গজেব যুদ্ধের খরচ মেটাতে অতিরিক্ত করের বোঝা চাপান। তাতে যে-বিদ্রোহ ছড়ায়, তা সামলাবার সামর্থ্য পরবর্তী মোগল সম্রাটদের ছিল না।
সব মিলিয়ে এইটুকু বোধহয় বলা যায়, পুরো ভূখণ্ড একক অধিকারে ‘ভারতবর্ষ’ নামে ব্রিটিশ শাসনের শেষ নয় দশকের আগে কোনো সময়েই ছিল না। ওই ব্রিটিশ পর্বেও কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম ছিল। যেমন দেশীয় বেশ কটি রাজ্যে স্বাধিকার ছিল স্থানীয় রাজা বা নবাবের; এবং পণ্ডিচেরি ও চন্দননগর, ছিটমহল দুটো ফরাসি মালিকানায়, আর, গোয়া, দমন, দিউ – এই তিনটি সমুদ্রবন্দর পর্তুগিজ অধিকারে। তারপরেও বহু ভাষা, বহু ধরন, বহু ধর্মাচরণের বিচিত্র সমন্বয়ে সভ্যতার একটা ভারসাম্য কালপ্রবাহে গড়ে উঠেছিল, যাকে একই বৃত্তের বলে চিনে নেওয়া যেত। রাষ্ট্র বা রাজ্য শাসনে বহুলতা ও বিভিন্নতা তাতে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সময়ের ধারাবাহিকতায় শতরঞ্চির নানা রং ও ছাপের মতো তারা ফুটে ওঠে। মিশে যায়। তবে একই সঙ্গে কিন্তু উপমহাদেশের বিশাল বিস্তারে বিপরীত দুই প্রান্তের জীবনভাবনা ও জীবনযাত্রার ধারায় বিচ্ছিন্নতার ও বৈসাদৃশ্যের ধরনই অভিজ্ঞতার পৌনঃপুনিক অভিঘাতে অমোচনীয় আকারে স্থায়ী রূপ পেয়ে যেতে পারে। আমরা জানি, এখানে উত্তর পশ্চিম খণ্ড, যা আজ পাকিস্তান, তারই প্রবেশের নানা পথ দিয়ে দূর অতীত থেকে প্রাক-ব্রিটিশ পর্ব পর্যন্ত ‘রণধারা বাহি জয়গান গাহি উন্মাদ কলরবে’ বহুবিচিত্র স্রোতে আগ্রাসী অভিযাত্রী দল বারবার হানা দিয়ে ভেতরে ঢুকে স্থায়ী বসতি গড়েছে। মহাভারতের যুদ্ধভূমি সেখান থেকে বেশি দূরে নয়। আলেকজান্ডার, কনিষ্ক, গুপ্ত-পর্বে শক, হুন যোদ্ধাবাহিনী, পরে পাঠান, মোগল, তুর্কি-পারসি বসতি ও রাজ্যস্থাপনে উচ্চাভিলাষীরা, সবাই এসেছেন এই পথে। শুরুতে যাযাবর আর্যরাও। তাই অস্ত্রের ঝনঝনানি ও জোরজবরদস্তির পাশবিক আড়ম্বর এ অঞ্চলে সভ্যতার ঐতিহ্যে মেশে। উলটোদিকে পুবের অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ-প্রাগজ্যোতিষপুর অঞ্চল তুলনায় শান্ত, পরস্পরসংলগ্ন ও গণমানুষের আকারে-প্রকারে সমজাতীয়। মূলত অস্ট্রোমোঙ্গলীয়। আর্য ও সেমিটিক মিশ্রণ নিতান্তই ক্ষীণ, এবং কাল বিচারে অর্বাচীন। সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ প্রাচীনতর ও মূলত কৃষিনির্ভর। জনগণের পারস্পরিক সহমর্মিতা প্রবল। মেজাজে ও আচরণে সংগত কারণেই ব্রিটিশ ভারতের পূর্বপ্রান্ত ও উত্তর-পশ্চিম খন্ডের জনবসতিতে অমিলই বেশি। ধর্মবিশ্বাসে ও আচরণে মোটাদাগে কোনো ঐক্যরেখা অধিকাংশের ভেতরে টানা যেতে পারে। কিন্তু সেই রেখা উপমহাদেশ ছাড়িয়ে
পুবে-পশ্চিমে বহুদূর যায়। এবং এই সাধারণ বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও পশ্চিম সীমান্ত পেরিয়ে কটি দেশ নিয়ে বিশাল এলাকাজুড়ে যে জনবসতি তা ইতিহাসের ধারায় পারস্পরিক হানাহানিতে অবিরাম মত্ত। বিপুল মানব-বিপর্যয়ের শেষ নেই, সেখানে এখনো।
তবে ব্রিটিশ ভারতে উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল ছিল গোটা ভূখণ্ডে একই প্রশাসনিক কাঠামোয়। উনিশ শতকের সাতের দশকেই উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বাংলা রেল যোগাযোগে বাঁধা পড়ে। টেলিগ্রাফের তার আন্তর্জাতিক তথ্য সরবরাহে এই অঞ্চলগুলোকে সরাসরি কার্যকরভাবে যুক্ত করে প্রায় সমসময়ে। তাই উভয়ের ভেতর ভাবনার আদান-প্রদান, পারস্পরিক সৌহার্দ্য বা বিদ্বেষ, স্বার্থের মিল-অমিল, এসব বস্তুগ্রাহ্যভাবে আগের চেয়ে বেড়ে যায় অনেকগুণ। ব্যক্তির পর্যায়ে যেমন, তেমনি সমষ্টির ভাবনাতেও। একরৈখিকভাবে নয়। বহু রেখার পারস্পরিক যোগাযোগে; কাটাকাটিতেও। এবং তা চলমান। সার্বিক বোঝাপড়াও কোনো স্থিরবিন্দুতে অবিচল থাকবে, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। মানব বাস্তবতা সব সময়েই এমন।
তবে প্রযুক্তি বিপ্লব যেমন নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে তেমনই অনিশ্চয়তার গভীরতা ও ব্যাপ্তি দুই-ই বাড়ায়। এ ভূখণ্ডে শুরু তার উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে। ঔপনিবেশিক স্বার্থ তাতে ইন্ধন জোগায় অবশ্যই। কিন্তু এখানে জনগণের চিন্তায় ও কাজে পরোক্ষ প্রতিক্রিয়াও হয় বিপুল।
কথাগুলো মনে রাখি শেখ মুজিবুর রহমান নামে এক পল্লিবালকের ক্রমাগত বেড়ে ওঠায় অর্জন ও বিসর্জনে মানুষী পূর্ণতার দিকে যে-অভিযান, তাতে বিপত্তি ও সিদ্ধি, বিনাশ ও গৌরব, – সব মিলিয়ে তাঁর ব্যক্তিতার সীমা ও বিস্তার যতটুকু পারি বোঝার আন্তরিক চেষ্টায়। তাঁর কাল ও পরিবেশ যেমন তাঁর আপন সত্তার ভিত্তি রচনা করে, তেমনি আপন বলিষ্ঠতায় তাদের ওপরও তিনি তাঁর গভীর ছাপ এঁকে রেখে যান। প্রবলভাবে তা প্রাসঙ্গিক থাকাতে এই দেশেরও কল্যাণ। অবশ্য বহু মানুষের দায়িত্বও উপেক্ষণীয় নয়। প্রতিটি বর্তমানে তা বর্তায়। কী করি, কীভাবে করি, এসব সিদ্ধান্ত নেবার অনিবার্য চাপ মাথায় নিয়ে চলতে হয় প্রাপ্তবয়স্ক সব সক্ষম মানুষকেই। এবং তা সময়ের ধারাবাহিকতায় প্রবহমান। ‘আমার জীবনে লভিয়া জীবন জাগোরে সকল দেশ’ – এই অলিখিত বাণী তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলে। তবে জাগা-না-জাগার ওপর তাঁর কোনো হাত থাকে না। সামনের দ্বান্দ্বিক বাস্তবতায় ব্যক্তি ও সমষ্টি কে কখন কীভাবে সাড়া দিই, এ তার ওপর নির্ভর করে। যদিও উভয়েই বহন করে জেনে-না-জেনে অতীতের চলমান ঐতিহ্য। তাতে অনাসৃষ্টির বিপন্নতাও। তাঁর মতো কাউকে আক্ষরিক অর্থে অনুকরণ করে চললেই দেশ আবশ্যিকভাবে জেগে ওঠে না। কারণ বাস্তব কখনোই এক জায়গায় থাকে না। সমূহ জীবনের পরিবর্তনশীল ছকে হাঁ-না-র সমীকরণরাশিতে সৃষ্টিশীল সমাধানের দুঃসাহসী উদ্যোগে সব বিপদ তুচ্ছ করে কোনো আড়াল না রেখে এগিয়ে যাবার প্রেরণাতেই মেলে তাঁর জীবনে জীবন লাভ করার প্রয়াস। এতে যদি তাঁর সময়ের কোনো জরুরি পদক্ষেপ পালটাতে হয়, তবুও। সৃষ্টিশীলতায় শ্রেয়োচেতনাই তাঁকে অনুসরণের মন্ত্র জোগায়। সমকালের অনিবার্য তাগিদ ওই শ্রেয়োচেতনায় ছাপ ফেলে। তাঁর বেলাতেও এমন ঘটেছে।
আগেই বলেছি তাঁর জন্ম টুঙ্গিপাড়ায়। পরিবারের নাম-ডাক সেখানে যথেষ্ট। দু-পুরুষ আগে থেকে ইংরেজি শিক্ষার চল। তাঁর এক দাদা ‘খানসাহেব’ও হয়েছিলেন। বাবা সেরেস্তাদার। সেই সুবাদে মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, তখনকার এইসব ছোট শহর তাঁর কর্মস্থল। টুঙ্গিপাড়ার হালচালের বৃত্তেই। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে এসব জায়গায়। তবে তা নির্ঝঞ্ঝাট ছিল না। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় হৃৎপিণ্ডে সমস্যা ধরা পড়ে। তাতে পড়াশোনায় দু-বছরের ছেদ। পরপরই চোখ আক্রান্ত হয় গ্লুকোমায়। তার জন্যেও স্কুলে পড়াশোনায় বাধা। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। পরে সেখান থেকে যথারীতি বিএ পাশ করেন। এই যে ধরাবাঁধা শিক্ষাজীবন এতে কোনো বিশেষত্ব নেই। কিন্তু পাশাপাশি তাঁর মনের বিকাশ হয়ে চলেছে পরিপার্শ্বের ঘটনাস্রোতে বহু উত্তেজনার প্রভাবে। নিষ্ক্রিয়ও তিনি থাকেন না; সর্বান্তঃকরণে ওই কর্মপ্রবাহে জড়িয়ে পড়েন। নিজের বিষয়ে বলতে গিয়ে অকপটে তিনি জানান, ছেলেবেলায় খুব ডানপিটে ছিলেন। খেলাধুলা করা, গান গাওয়া আর খুব ভালো ব্রতচারী নাচা, এসবে তাঁর স্বাভাবিক দক্ষতা ছিল। ছেলেদের একটা দল ছিল। নেতা ছিলেন তার। হুড়-হাঙ্গামায় জড়াতেন। যখন অসুস্থ ছিলেন, তখন এসবে ছেদ পড়ে। একমাত্র কাজ কেবল বিকেলে সভায় গিয়ে বক্তৃতা শোনা। স্বদেশি আন্দোলনের যুগ। তার উত্তেজনা তাঁর ভেতরেও ছড়ায়। সুভাষ বোসের কর্মকাণ্ড তাঁর কিশোরমনে দাগ কাটে। বাড়িতে খবরের কাগজ রাখা হতো আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ। এছাড়া মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত। তিনি সবগুলোই পড়তেন। কৌতূহল মিটত। জাগতও। মনের দরজা খুলে যেত। ১৯৩৮ সালে শেরে বাংলা ফজলুল হক বাংলার প্রধানমন্ত্রী, সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। মুসলিম লীগের সভা করতে তাঁদের গোপালগঞ্জে আসা। ছোট শহরে বিপুল আলোড়ন। আয়োজনে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতৃত্বে শেখ মুজিব। তখনই শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের সূত্রপাত।
শহীদ সাহেব কলকাতা ফিরে তাঁকে চিঠি দেন। জানান, কলকাতা গেলে যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তিনিও সাড়া দেন। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটা ফলপ্রসূ সম্পর্কের শুরু এইভাবে।
১৯৩৯-এ তাঁর প্রথম কলকাতা দর্শন। তখন আবার সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সংস্পর্শে আসা। তিনি গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের সংগঠন গড়ে তোলার অনুমোদন নিয়ে ফেরেন। তাঁর আন্তরিক চেষ্টায় ও প্রত্যক্ষ সংযোগে দুটোতেই সফল হন। বিয়াল্লিশে ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতায় চলে আসেন, ভর্তি হন ইসলামিয়া কলেজে। আর থাকেন বেকার হোস্টেলে। অচিরেই হয়ে ওঠেন মুসলিম ছাত্রলীগের অপরিহার্য নেতৃস্থানীয় একজন। সাংগঠনিক দক্ষতা, সততা ও কর্মনিষ্ঠা তাঁকে আলাদা করে চেনায়। সোহরাওয়ার্দী তাঁর আদর্শ। চিন্তায় প্রাগ্রসর। পাকিস্তান তাঁর স্বপ্ন, যেখানে তাঁর বিশ্বাস, ওই সম্ভাব্য রাষ্ট্রের নামহীন জনগণ মান্যতা পাবে।
তবে ওই কালপর্বে গোটা মানববিশ্বই খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আঘাত আমাদেরও বিপন্নতায় হতবিহ্বল করে। পাশাপাশি গোটা উপমহাদেশজুড়ে স্বাধীনতা-সংগ্রামের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ এবং তারই অনুষঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্র নির্মাণের দুর্দম উদ্যোগ। প্রতিটি কাণ্ডই ব্যক্তি ও সমষ্টির চিন্তায় ও কর্মে আলোড়ন জাগায়। তা অভূতপূর্ব। প্রাপ্তির প্রত্যাশার সঙ্গে মিশে থাকে ক্ষত ও ক্ষতির লাঞ্ছনা। শান্ত ও নিস্তরঙ্গ জীবন আকস্মিকতার একাধিক অকল্পনীয় আঘাতে ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়; যদিও তাদের সম্ভাবনারাশি লালন করেছি আমরাই। এখানে, এবং সবখানে।
মুসলিম লীগ, এবং মুসলিম ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন শেখ মুজিব। দেখেন পঞ্চাশের মন্বন্তর, লক্ষ লক্ষ মানব-মানবীর শহরের পথে পথে পড়ে থাকা শব – প্রতিবাদহীন, উদ্যমহীন, সান্ত্বনাহীন বোবা অভিযোগ, আরো আসে ফেউ-এর মতো কা-জ্ঞানহীন উন্মত্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, – মানুষে-মানুষে একত্র বসবাসের সুদীর্ঘ অভ্যাসে পুঞ্জীভূত ঘৃণার উৎকট পাশবিক উন্মত্ততা, নিরপরাধ আকস্মিক জন্মদাগ নির্ধারণ করে কে কার বৈরী, পরিণামে সব মানুষের মনোজগতে গজিয়ে ওঠে অসংখ্য অদৃশ্য প্রতিরোধের দেওয়াল, পরস্পর নির্ভরতা হারিয়ে যায় অবিশ্বাসে।
মন্বন্তরের সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন গণসরবরাহমন্ত্রী। তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে শেখ মুজিব পথে নেমেছেন ত্রাণ বিতরণে। নির্বিশেষ অসহায় মানব-মানবীর মৃত্যুতাড়িত মুখ তাঁর মনে গভীর ছাপ ফেলে। হয়তো তখনো স্পষ্ট হয়নি, কিন্তু এর প্রভাব তাঁকে পরে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার সংকল্পে প্রেরণা জুগিয়েছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর একটা পৈশাচিক বিভীষিকা। অসহায় মানুষ উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তির হাতে নির্বিবেক দাবার ঘুঁটি। রাজা-মন্ত্রী-পাত্র-অমাত্যদের দখল বাড়াতে ওই সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলে ঘুঁটিগুলো অনায়াসে বলি দেওয়া যায়। স্বার্থের অর্থবহ জগতে তারা অবান্তর। এর আকস্মিক, হতে পারে কোথাও থেকে অদৃশ্য সুতোর টানে সুপরিকল্পিত, হামলায় জনজীবনে শান্তি ও সুস্থিতি উচ্ছন্নে যায়। শেখ মুজিব তখন দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন দাঙ্গা প্রতিরোধে। কে কোন সম্প্রদায়ের, তার বাছ-বিচার করেননি। এই অকরুণ অমানবিক-কাণ্ডের অভিশাপ চেতনায় বহন করে তিনি তখন আপন হৃদয়ের ধরাবাঁধা সীমা অতিক্রমের সাহস ও শিক্ষা দুই-ই অর্জন করেন।
বাংলা মুসলিম লীগে তখন মোটাদাগে দুই ধারা : একটি প্রাচীনপন্থী সামন্ত ভূস্বামীদের ধ্যান-ধারণার অনুসরণে, অন্যটি আধুনিক শিক্ষা ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলার মাধ্যমে গণমুখী চেতনা বিকাশের পক্ষে। প্রথমটির নেতৃত্বে খাজা নাজিমউদ্দীন, নূরউল আমীন, শাহাবুদ্দীন ও এই রকম মানসিকতা যাঁদের, তাঁরা। দ্বিতীয়টিতে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও তাঁদের প্রখর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ অনুসারীরা। তবে অধিকাংশ সুবিধাবাদী যখন যেদিকে সুযোগ, তখন সেদিকে ভিড়তেন। সোহরাওয়ার্দীর একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন শেখ মুজিব। অবশ্য পাকিস্তান কায়েম করার লক্ষ্যে কারো মনে কোনো দ্বিধা ছিল না। তারই টানে অন্যান্য দল থেকেও বিভিন্ন সময়ে অনেকে মুসলিম লীগে এসে যোগ দেন। সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। তাঁর সেরা কীর্তি, ‘ঋণ সালিশি বোর্ড’ করে বাংলার কৃষকদের অনেকখানি মুক্ত করা। এজন্যেই তিনি অমর। তাঁর পরবর্তী কর্মকাণ্ডে বিভ্রান্তিই বাড়ে। অনেক দুর্দিনের তাঁরা সঙ্গী।
সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের একটা বড় সীমাবদ্ধতা ছিল, তখনকার পূর্ব বাংলায় শক্ত কোনো ভিত গড়ার সুযোগ তাঁরা পাননি। আবুল হাশিমের বাড়ি বর্ধমান। তাঁর খ্যাতির উৎস সেখানেই। আধুনিক ভাবধারায় লালিত এক সম্ভ্রান্ত বংশে জন্ম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। তাঁর বড়ভাই শাহেদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন কলকাতার হাতেগোনা সেরা চিন্তাবিদদের একজন। সম্ভবত শ্রেষ্ঠ শিল্প-সমালোচক। বিষ্ণু দে, যামিনী রায়, অতুল বোস, সত্যেন বোস, সুধীন দত্ত, এঁরা ছিলেন তাঁর দৈনন্দিন আড্ডার সঙ্গী। ব্যারিস্টার হিসেবে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর খ্যাতিও ছিল ভারতজোড়া। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তাঁরা এখানে হটা-বাহার। খ্যাতি তাঁদের মিলেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপস করেই প্রতিভা তাঁদের নির্বাপিত হয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টিতে তাঁদের উল্লেখযোগ্য অবদান থাকলেও ওই রাষ্ট্রের শক্তি-কাঠামোর কায়েমি স্বার্থচক্র তাঁদের লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে বাধ্য করেছে। নতুন রাষ্ট্রে তাঁরা উদ্বাস্তু। আসেন তার জন্মের পর দু-বছর পার করে। রাজনৈতিক ডামাডোলে সোহরাওয়ার্দী একবার প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল পুতুলনাচের একটা পালা। যে-সুতোর টানে পুতুল নাচে, তা শক্ত হাতে ধরা থাকে পর্দার অন্তরালে। এই অন্তরালও যখন অবান্তর মনে হয়, তখন ‘বন হতে’ টিয়ে বেরোয় ‘সোনার টোপর মাথায় দিয়ে’। উনিশশো আটান্ন সালে। সেনাশাসন, স্বৈরাচার ও রাষ্ট্র মিলেমিশে একাকার। কায়েমি স্বার্থের গোপন মুখ সব প্রকাশ্যে দাঁত বের করে। পুরনো ফন্দির অভ্যস্ত ছ্যাঁচড়ামিও তার সঙ্গে জোটে। নিজ ভূমে মানুষ পরবাসী হয়ে পড়ে। লোভ ও লাভের বেসাতি রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কুরে কুরে খায়।
অবশ্য সমূহ পতনের শুরু ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার লগ্নেই। অনেকের কাছে ছিল মুসলিম লীগ ও রাষ্ট্র সমার্থক। রাষ্ট্রক্ষমতার হুকুমতেই স্মরণীয় খিলাফতের প্রতিফলন। তবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব, কারণ যা-ই হোক, ঘটনা হিসেবে এই উপমহাদেশে অভূতপূর্ব নয়। অখণ্ড ভারতবর্ষের ধারণা, আগেই দেখেছি, একক প্রশাসনিক ক্ষেত্র হিসেবে ব্রিটিশ শাসনের আগে কখনো আকার পায়নি। তা সত্ত্বেও ভূখণ্ডটির মানববসতি সংযোগে ও মিশ্রণে খোলামেলা একটা ভাবরূপ তৈরি করতে পেরেছিল। শংকরাচার্য, মীরাবাঈ, কবির দাদু, রজ্জব, নানক, খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া, মহাত্মা লালন শাহ, এঁদের অবদান ও গৌতম বুদ্ধের দেশনা তাতে সমন্বয় ঘটায়। রাজ্য বা সাম্রাজ্য কখন কার দখলে, এর ছাপ তার ওপর সামান্যই পড়ে। পাকিস্তান স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হয়েও তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারত। কিন্তু এখানে ক্ষমতার দখলদার যখন যে হয়েছেন, তখনি সে রাষ্ট্রকে তাত্ত্বিকভাবে বিশেষ এক ধর্মের অনুশাসনের ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছে। এতে স্ববিরোধেরও জন্ম। পশ্চিমখ- নিশ্চিতভাবে হরপ্পা, মহেনজোদারো, কুরু-পা-ব কথা ও গান্ধার শিল্পের উত্তরাধিকার দাবি করতে পারে। তা সে করেনি। অন্যদিকে, আগ্রার তাজমহল, দিল্লির লাল কেল্লা, কুতুব মিনার, দক্ষিণে সালার জং জাদুঘর, হায়দার আলী বা টিপু সুলতানের স্মৃতি, এদের কোনোটিকেই সে নিজের বলতে পারে না। ফলে যে কূপমণ্ডূকতা তাকে গ্রাস করে, তা থেকে তার রেহাই মেলে না। পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের আবেগ-ঋদ্ধ সমর্থন ছিল একশভাগ খাঁটি। কিন্তু তাতে উপমহাদেশীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির অখণ্ড উত্তরাধিকারে দ্বিধাহীন আস্থাও ছিল একই রকম প্রবল। তাঁর জীবনই যদি তাঁর বাণী হয়, তবে তাতেই ঘটে এর প্রতিফলন। এবং তা ক্রমাগত বিবর্তিত হয়েছে সাম্প্রদায়িক অবস্থান থেকে বৃহত্তর মানবিক দায়িত্ববোধের ধারায়। কঠিন ছিল যাত্রাপথ। তিনি বিচলিত হননি। নতিস্বীকারও করেননি।
তিন
উনিশশো সাতচল্লিশের চোদ্দই আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম। সময়ের প্রেক্ষিতে ছিল তা নিতান্ত অভিনব। ব্রিটিশ ভারতের দুটো প্রান্তীয় অংশ ছেঁটে নিয়ে তাদের এক করা। মাঝখানে দেড় হাজার মাইলের ব্যবধান। স্থলভাগ, এবং সবটাই ভারতে। সাম্প্রদায়িক ভাগ-বাটোয়ারার ফলে এমন। গণমানুষের আদিম অনুভূতিতে এ সাড়া জাগায় যথেষ্ট, কিন্তু রাষ্ট্রের নৈর্ব্যক্তিক সম্পূর্ণতা ও সামর্থ্য অর্জনে এর অবদান সামান্য। কখনো বা নেতিবাচক। বিষয়টি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর যে নজরে পড়েনি, তা নয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই এক বেতার ভাষণে তিনি বলেন, ‘আজ থেকে এই স্বাধীন রাষ্ট্রে কেউ মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান বা এই রকম কোনো ধর্মসূত্রে পরিচিত হবে না। আমরা সবাই পাকিস্তানি।’ কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে অনেক। এমনকি একই ধর্মাবলম্বী কে সাচ্চা আর কে সাচ্চা না, এ নিয়েও সেখানে এখনো বিতর্ক প্রবল। অখণ্ড পাকিস্তান পর্বেই লাহোরে সেনাবাহিনী নামিয়ে কাদিয়ানিদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়। রাষ্ট্রীয় ঘোষণায় তখন থেকে তারা অমুসলিম। শরিয়া আইন চালু হওয়ার পর অসহিষ্ণুতা আরো বাড়ে।
পাকিস্তান আন্দোলনে মুসলিম লীগে তরুণ কর্মী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের উৎসাহে ও কর্মকাণ্ডে কোনো ঘাটতি ছিল না। বিষয়টিকে তিনি দেখেছিলেন বাংলায় সংখ্যাগুরু মুসলমান কৃষক-শ্রমিকদের তুলনায় হীন ও অসহায় অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে। অন্যদের জাত-পাত নিয়ে বাছ-বিচারও তাঁকে ক্ষুব্ধ করেছিল। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, পাকিস্তান এইসব বৈষম্যের অবসান ঘটাবে। মনোজগতের বদ্ধ কপাট সব খুলে দেবে। সোহরাওয়ার্দীর মেধা, ব্যক্তিত্ব, উদারতা ও কর্মদক্ষতা তাঁকে আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত করেছিল। তাঁকেই তিনি তাঁর নেতা মেনেছিলেন। আশা করেছিলেন, অখণ্ড বাংলায় মুসলিম লীগ শাসনে যিনি প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে তাঁর ধারাবাহিকতা এই পূর্বাঞ্চলে বজায় থাকবে। কিন্তু তা হয় না। অন্তর্দলীয় চক্রান্তে কোণঠাসা হলেন সোহরাওয়ার্দী। পূর্ব বাংলার ভূমিপুত্র তিনি নন। কলকাতার অভিজাত মুসলমান পরিবারে বাংলা ভাষার চল তেমন ছিল না। তাঁর বেলাতেও এমন। নেতৃত্ব নিয়ে দলাদলিতে এসব তাঁর বিরুদ্ধে যায়। তাছাড়া নগদ প্রাপ্তির আশায় অনেকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিশ্বাস ভঙ্গ করে। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের শাসকচক্রের কাছে তিনি ‘অবাঞ্ছিত’ হয়ে পড়েন। পাকাপাকি পাকিস্তানে আসেন স্বাধীনতার বছরদুই পরে। তাও এখানে নয়, করাচিতে। স্বাধীনতা লাভের পরপরই শেখ মুজিব কলকাতা থেকে ঢাকা চলে আসেন। বিএ পাশ করেছেন ইসলামিয়া কলেজ থেকেই। ঠিক করেন, আইন পড়বেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তিও হলেন। তবে মুসলিম লীগে তাঁর সাংগঠনিক কাজ বেড়ে গেল আরো। খাজা নাজিমউদ্দীন মুখ্যমন্ত্রী। মওলানা আকরম খাঁ দলীয় সভাপতি। তাঁরাই সর্বেসর্বা। অ্যাডহক কমিটি গড়ে ছড়ি ঘোরান। তাতে মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্যপদ শেখ মুজিবের আপনা থেকে খারিজ হয়ে যায়। অবশ্য মুসলিম ছাত্রলীগে কর্মতৎপরতা তাঁর আগের মতোই থাকে। জনসম্পৃক্ততাও বাড়ে। অসাধারণ বক্তা বলে অচিরেই তাঁর নাম ছড়ায়। অন্যদিকে মুসলিম লীগ ক্ষমতালিপ্সু সাম্প্রদায়িক গণবিচ্ছিন্ন সুবিধাভোগী একটা চক্রে পরিণত হতে থাকে। শাসনক্ষমতা তাদের হাতে। অথচ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ও কাণ্ডজ্ঞান দুটোরই বড় অভাব। নির্ভর করতে থাকেন তাঁরা আমলাদের ওপর, বিশেষ করে যাঁরা আইসিএস। এঁরা প্রায় সবাই তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানের। এর বিষময় ফল ভুগতে হয়েছে এই বাংলার মানুষকেই। বিপরীতে ওই ফল ভুগতে হয়েছে বলেই তাদের বিক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে বারবার। সেখানে শেখ মুজিবের প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব মহীরুহ হয়ে ক্রমশ আকাশ ছুঁয়েছে। পাকিস্তানের মোহ ভাঙতে তাঁর দেরি হয়নি। ওই রাষ্ট্রযন্ত্রও বারবার তাঁকে নির্যাতনে নির্যাতনে ধ্বংস করতে চেয়েছে। তিনি হার মানেননি।
পাকিস্তান কায়েমের পর এক বছরও পার হয়নি, ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র প্রস্তুতিকরণ সভার (কনস্টিটুয়েন্ট এসেম্বলি) বৈঠক বসে তখনকার রাজধানী করাচিতে। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম সদস্যরাও উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তাদের পশ্চিম পাকিস্তানি সভ্যদের সঙ্গে সমস্বরে সহমত প্রকাশ করেন। এটাও খেয়াল করবার, কোনো কোনো নামজাদা পশ্চিম পাকিস্তানি দলীয় সদস্য তখন পূর্বাঞ্চল থেকে মনোনীত হয়েছেন, এবং এখানকার প্রতিনিধিদের কারো কারো হীনমন্যতা ছিল এতই প্রবল যে ওই বহিরাগতদের কাছে নিজেদের বিশ্বস্ততা প্রমাণে তাঁদের কথা শতগুণ বাড়িয়ে বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করতেন। ওই সভায় রাষ্ট্রভাষা-সংক্রান্ত প্রস্তাবটির সংশোধনী এনে তখনকার কংগ্রেস সদস্য কুমিল্লার ধীরেন দত্ত যোগ করেন, শুধু উর্দু নয়, সেই সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ, বাংলাই এখানে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা। সেখানে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশোধনী খারিজ করে দেওয়া হয়। সেখানে প্রতাপশালী বঙ্গসন্তানরাও তাতে গলা মেলাতে কসুর করেননি। কিন্তু এই ঘটনাই সূত্রপাত করে পূর্ব বাংলায় প্রতিবাদ-যাত্রার, এবং তাতে অগ্রণী ভূমিকা থাকে ছাত্রসমাজের। তখনো দেশে সাক্ষরতার হার শতকরা দশের কোঠায়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সম্প্রদায় ফলে গণমানসে বিশেষ গুরুত্বের। তাদের কাছে খবরটা পৌঁছুলে সারাদেশে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও জেলা শহর-কলেজগুলোয় যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়, তা অপরিণামদর্শী কর্তাব্যক্তিদের ছিল চিন্তারও বাইরে।
শেখ মুজিব তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আপসহীন ছাত্রনেতা ও অসাধারণ বক্তা। শিক্ষানবিশির পর্ব কেটে গেছে পাকিস্তান আন্দোলনে কলকাতায়। তখন কিন্তু হাজতবাসের অভিজ্ঞতা তাঁর হয়নি। শুরু হলো তা পাকিস্তানে, দেশটি সৃষ্টির ক-মাসের ভেতরেই। প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা তাঁরই মুসলিম লীগের হাতে।
নেতৃত্বে খাজা নাজিমউদ্দীন। সেই শুরু। তারপর বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও তাঁর মুক্তিতে পূর্ণতা পাবার আগ পর্যন্ত কারাগারেই কেটেছে তাঁর বেশিরভাগ সময়। অবশ্য পঞ্চাশের দশকে স্বল্পপরিসরে মন্ত্রীও ছিলেন। এবং জেলে, অথবা জেলের বাইরে, যেখানেই থাকুন না কেন, তাঁর গুরুত্ব ক্রমাগত বেড়েছে। একসময় বাংলা, বাঙালি, শেখ মুজিব একবিন্দুতে সমার্থক হয়ে উঠেছে।
ছাত্র নেতৃবৃন্দ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ ঘোষণার মাধ্যমে সারাদেশে প্রতিবাদ মিছিল, পথসভা ইত্যাদির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে তাকে যথোচিত গুরুত্বের সঙ্গে উদযাপনের আহ্বান জানায়। ওইদিনই পিকেটিংয়ে নেতৃত্ব দেবার সময় তিনি গ্রেফতার হন। গ্রেফতার হন আরো একদঙ্গল ছাত্র। অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরও বাদ পড়েনি। প্রথম কারাবাসের মেয়াদ ছিল তাঁর পাঁচদিন। ১৯ মার্চ কায়েদে আজম ঢাকা এসে আবার সরকারি সিদ্ধান্তের পুনরাবৃত্তি করেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। সাধারণ জনসভাতে একবার, বিশ্ববিদ্যালয়ে কনভোকেশনে আর একবার। দুবারই তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে ছাত্ররা। বাংলার ইতিহাসে স্মরণীয় ঘটনা। পরে প্রকাশ্য প্রতিবাদ সভায় শেখ মুজিবও গলা মেলান। ‘সংগ্রাম পরিষদের’ পালে জোর হাওয়া লাগে। তার আবেদন দেশে ‘ছড়িয়ে গেল সবখানে’।
১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ পরলোকগমন করেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন খাজা নাজিমউদ্দীন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান যেমন ছিলেন, তেমনি থাকলেন। তবে ক্ষমতার রাশ পুরোপুরি চলে গেল তাঁর হাতে। অবশ্য নাজিমউদ্দীনের ব্যক্তিত্বহীন সম্মতি ছিল সবেতেই। বাংলায় খাদ্য আন্দোলন, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন, সব ক্ষমতার দাপটে স্তব্ধ করে দেবার প্রদর্শনী আরো জোরেশোরে চলতে থাকল। এদিকে পূর্ব বাংলায় নাজিমউদ্দীনের জায়গায় সরকারপ্রধান হয়ে বসেছেন নূরুল আমীন। আসলে তিনি আজ্ঞাবহ দাস। ব-কলমে আসল ক্ষমতা আইসিএস মুখ্য সচিব আজিজ আহমদের হাতে। জনগণের সেবা নয়, পাকিস্তানি উন্নাসিকতায় দখলদারিত্ব বজায় রাখাই তাঁর লক্ষ্য। শোনা যায়, বায়ান্নয় ভাষা-আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর গুলি চালাবার হুকুম দিয়েছিলেন নূরুল আমীনের নামে তিনিই। সরকারপ্রধানের তা মুখ ফুটে বলার সাহসটুকুও ছিল না। কারণ, প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার সদস্যদের ওপর গোপন নথি তিনি তৈরি রাখতেন। লিয়াকত আলী খানের কাছে তাঁর গুরুত্ব ছিল তুলনায় বেশি। সম্ভবত সেনাবাহিনীর দফতরেও। পরে আইয়ুব, ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা এই রকমই ইঙ্গিত দেয়।
এদিকে শেখ মুজিবের ভাগ্যে জুটল বারবার জেলে যাওয়া ও জেলা থেকে বের হওয়া। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের সময় তিনি টানা প্রায় তিন বছর নিরাপত্তা আইনে বন্দি। ওই অবস্থাতেই তিনি জেলখানার জানালা দিয়ে বাইরে ‘বাংলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে’র মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, ২১ ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ বলে পালন করা হবে, আর, ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে মুক্তির জন্য তিনি আমরণ অনশন শুরু করবেন। তিনি সরকারকে জানিয়ে দেন, তিনি লিখছেন, ÔEither I will go out of the jail or my deadbody will go out.Õ টানা বারোদিন অনশনের পর তাঁর মুক্তি জোটে।
আগেই অবশ্য বের হয়ে এসেছেন তিনি পুরনো মুসলিম লীগ থেকে। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। সভাপতি মওলানা ভাসানী, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক ও শেখ মুজিব যুগ্ম সম্পাদক। ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামটা অবশ্য অনন্যপূর্বা নয়। কিছু আগে পশ্চিম পাকিস্তানেই পীর মানকী শরীফ এই নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। তবে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগে’র আবির্ভাব একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে। এই নামেই এর গঠনতন্ত্রের অনুমোদন। পরে বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের অভিঘাতে যে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে যায়, তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে ১৯৫৫ সালের বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে এর সাম্প্রদায়িক পরিচয় মুছে দেওয়া হয়। দলের নাম তখন থেকে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। মওলানা ভাসানী তখনো সভাপতি। তবে সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৭-তে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ছেড়ে যান। পরে হোসেন সোহরাওয়ার্দী হন সভাপতি, শেখ মুজিব থেকে যান সাধারণ সম্পাদক। ১৯৬৩-র ডিসেম্বরে সোহরাওয়ার্দীর জীবনাবসানের পর দলের অবিসংবাদী নেতা হয়ে ওঠেন শেখ মুজিবুর রহমান। ছেষট্টিতে বিখ্যাত ছয় দফা দাবি নিয়ে এই বাংলার মানুষের সামনে তিনি হাজির হন। দেশের প্রবহমান বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর অনমনীয় দুঃসাহসী নেতৃত্ব শিখর স্পর্শ করে। আত্মসুখ সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে এই বাংলার গণমানুষের কল্যাণের জন্যে হাতে কিছু না রেখে জীবন কর্মের পথে উৎসর্গ করা, এটাই তাঁকে আর সবার থেকে আলাদা করে চেনায়। তবে তাঁর দৃষ্টি পুরোটাই ছিল এই বাংলাকেন্দ্রিক। তত্ত্বের কচকচিতে তিনি মাথা ঘামাননি। ক্ষমতাকে দেখেছেন তিনি লক্ষ্যে পৌঁছার উপায় হিসেবে।
সে-লক্ষ্য আত্মসুখ নয়। তা ‘ওই সব ম্লান মূক মূঢ় মুখে’ ভাষা জোগানো, আশা ‘ধ্বনিয়া তোলা’র পথ দেখানো। এবং সবটাই বাস্তব জীবনচর্চায়। সেখানে নির্বিবেক পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ও তাদের শোষণ ছিল সবটাই প্রত্যক্ষে। তাঁর লড়াইয়ের আহ্বানে প্রধান লক্ষ্য ছিল তারাই। যতই দিন গেছে, ততই তাঁর আন্দোলন জমাট বেঁধেছে। শাসক-শোষক চক্র যতই তাঁর ওপর খড়্গহস্ত হয়েছে, ততই সাধারণ মানুষের আস্থার আবেগ তাঁর ওপর বেড়েছে। তবে বাস্তবতার এক নির্মম কৌতুক, তাঁর রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দীর আকস্মিক মৃত্যু তাঁর কাছে যতই বেদনার হোক, এর কারণেই কিন্তু আওয়ামী লীগের সর্বেসর্বা হয়ে তিনি এই বাংলার মুক্তির পথে জনসমুদয়কে পরিচালিত করার সুযোগ পান। সোহরাওয়ার্দী প্রকৃতপক্ষে বাংলার গণমানুষের সঙ্গে একাত্ম ছিলেন না।
শিক্ষা-দীক্ষায় তিনি ছিলেন সমাজে উঁচুতলার একজন। পশ্চিম পাকিস্তানি অভিজাত বলয়ে তাঁর যোগাযোগ ছিল সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত। পাকিস্তানের অখ-তা তাঁর কাছে প্রাথমিক প্রত্যয়ের মতো ছিল। প্রধানমন্ত্রী হবার সুযোগ পেয়ে তিনি সমঝোতাতেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন বেশি। বাংলা থেকে সম্পদ পাচার তাতে বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি।
একই সময়ে শেখ মুজিব পাকিস্তানের শাসনযন্ত্রের অমানবিক নির্মমতায় ও স্বার্থান্ধ লোভের বিকট মুখব্যাদানে বীতশ্রদ্ধ হতে হতে তা থেকে মুক্তির পথ খোঁজার কথা ভাবতে শুরু করেন। শুরুতেই পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তাকে মাথায় নিয়ে নয়, তবে এই বাংলার মানুষের অধিকার ও কল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে।
আসলে জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তান একটা ভারসাম্যহীন রাষ্ট্র। আধুনিক গঠনতন্ত্রের কোনো উপাদানই সেখানে তখন আকার পায়নি। তাদের বিকাশ ঘটেনি এখনো। বরং কায়েমি স্বার্থের ধারাবাহিক শক্তি সঞ্চয়ে তারা রুগ্ন ও বিশৃঙ্খলই থেকে গেছে। এক সুসংহত ও সুশৃঙ্ঘল সেনাবাহিনী ঐতিহ্য-পরম্পরায় ও উত্তরাধিকার সূত্রে তার ছিল। ব্রিটিশ ভারতের কিছু উচ্চপদস্থ আমলাও তার জুটেছিল। আর ছিল সমাজব্যবস্থায় কর্তৃত্বপরায়ণ ভূস্বামীদের অচলায়তন। পিরামিডের মাথায় এরা পরস্পর আত্মীয়তা সূত্রে বেশিরভাগ আবদ্ধ। গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের সুস্থ আয়োজনের এরা অন্তরায়। এই পরিস্থিতির মৌলিক পরিবর্তন এখনো ঘটেছে বলে মনে হয় না। প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ককে অটুট রাখা যায় বোধ হয় ধর্মীয় মৌলবাদের অলৌকিক বন্ধনে। তাই তার দখলদারির প্রতিযোগিতাও সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সমাজের তৃণমূল স্তরেও তার রণধ্বনি বাজে। কায়েমি স্বার্থ জিইয়ে রাখায় এ জরুরি। আমাদের এই বাংলায় ব্যাপারটা গুণগতভাবে ভিন্ন। অমন পরাক্রমশালী কোনো চক্র এখানে গড়ে ওঠেনি। মুসলিম লীগের শাসনে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগে লালায়িত অতিউৎসাহী ফোড়ে বাহিনী একটা গড়ে উঠেছিল ঠিকই। কিন্তু তারা ছিল শুধু নাচের পুতুল। মূল পাকিস্তানি চক্র তাদের যথেচ্ছ ব্যবহার করেছিল। নাজিমউদ্দীন, নূরুল আমিন থেকে শুরু করে মোনেম খান, সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী বা মাহমুদ আলী, সবাই এই জাতের।
বিপরীতে শেখ মুজিব যখন দেখেছেন, ওই শোষকচক্রের কাছে এই বাংলা খণ্ড শুধুই শোষণক্ষেত্র, তার ভাষা ও সংস্কৃতি হতমান, তখনই তার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন, প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছেন, সামনে থেকে তাকে প্রত্যাখ্যানে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ঘৃণা থেকে নয়, প্রকৃত মনুষ্যত্বের মূল্যবোধ থেকে। এই বাংলার ঐতিহ্য তাকে লালন করে এসেছে। আর্য বা সেমেটিক রক্তের একক ঐশ্বর্য সে ধারণ করে না, যদিও তার মিশ্র সত্তায় তাদের প্রবাহও সে মান্য করে। এতে কোনো হীনমন্যতায় তিনি ভোগেন না। বরং এইটিই তাঁর কাছে ক্রমে হয়ে উঠেছে প্রকৃত গৌরবের। ‘মানুষ যদি হবি তবে কায়মনে বাঙালি হ’ – এই বাণীর সারমর্ম বাস্তবের অভিজ্ঞতায় তিনি সত্য বলে উপলব্ধি করেছেন। তার সুরক্ষা তাঁর জীবনসংগ্রামের ব্রত হয়ে উঠেছে।
১৯৫৪-র প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগবিরোধী যুক্তফ্রন্টের স্মরণীয় বিজয় শাসকদলের কর্মকাণ্ডে জনগণের বিপুল বিরাগের সন্দেহাতীত প্রতিফলন। তবে কার্যত প্রতীকীই থেকে যায়। বিপরীতে শাসক স্বার্থের নোংরা চক্রান্তে নির্মম বর্বরতার কুৎসিত চেহারাটাও খোলা চোখে ধরা পড়ে। নির্বাচনের পরপরই আদমজী পাটকলে বাঙালি-অবাঙালি শ্রমিক দাঙ্গার পেছনে পাকিস্তানি অপশক্তির কারসাজির কোনো আড়াল ছিল না। কলকাতায় শেরে বাংলার স্মৃতির আবেগে দেওয়া বিবৃতির কদর্থ করে তাঁকে দেশদ্রোহীর কাতারে সাজানোও ছিল উদ্দেশ্যমূলক। এইসব অজুহাতে কেন্দ্রীয় সরকার ৯২-ক ধারায় নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে জাঁদরেল সেনা অফিসার জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে আপৎকালীন সব ক্ষমতা দিয়ে গভর্নর করে পাঠায়। দখলদারদের কূটচালে গণতন্ত্রের চর্চা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। নির্বাচিত প্রাদেশিক সরকারে শেখ মুজিবও মন্ত্রী ছিলেন। অচিরেই তাঁর ঠাঁই হলো আবার কারাগারে। অবশ্য ক্ষমতার দখলদাররা পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে এলে তাঁকে তখনকার মতো মুক্তি দেয়। তিনি কিন্তু কোনো আপস করেন না। পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের শাসন ও শোষণ থেকে ওই কাঠামো বজায় রেখে মুক্তি যে সম্ভব নয়, এ-বিষয়ে তখন তিনি প্রায় নিশ্চিত।
তবে চুয়ান্নতে যুক্তফ্রন্ট গড়ে নির্বাচনে নামায় তাঁর ব্যক্তিগত আপত্তি ছিল। তাঁর আশঙ্কা ছিল এই পাঁচমিশালি তরকারিতে কোনো সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট লক্ষ্য থাকবে না। আমাদের বাংলার স্বার্থের ব্যাপারে কেউ কেউ উদাসীন থাকতে পারে। সুযোগসন্ধানীদের কায়েমি স্বার্থচক্রের কাছে বিকিয়ে যাবার আশঙ্কাও কম নয়। তিনি চেয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ একক শক্তিতে নির্বাচনী লড়াইতে নামুক। কিন্তু জ্যেষ্ঠ নেতাদের আপসকামিতায় তা সম্ভব হয়নি। পরের ক-বছরে এর কুফল বিকট হয়ে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে।
১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে। পাশাপাশি করাচিতে গণপরিষদে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিব প্রস্তাব করেন, পূর্ব পাকিস্তানের নাম বদলে পূর্ব বাংলা করা হোক। কারণ, ‘বাংলা’ শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য …’ তখন তা ছিল অরণ্যে রোদন। কিন্তু তাঁর লক্ষ্যে তিনি স্থির থাকেন। বিচলিত হন না।
এদিকে পাকিস্তানের শক্তিবলয়ে পরস্পর ঘনিষ্ঠ সেনাবাহিনী ও আমলাচক্র ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে থাকে। গোলাম মোহাম্মদ ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছিলেন ডাকসাইটে আমলা। জানা যায়, দুজনই ছিলেন সেনাবাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের বিশ্বস্ত। দুজনেরই অনুপ্রবেশ ঘটে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায়। পরে গোলাম মোহাম্মদ হন গভর্নর জেনারেল; আর চৌধুরী মোহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রী। সব ঘুঁটি পছন্দমতো সাজিয়ে নানা জায়গায় প্রয়োজনমতো বিশৃঙ্খলা ঘটিয়ে ১৯৫৮ সালে (৭ অক্টোবর) তখনকার গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে যোগসাজশে সেনাপ্রধান আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব জবরদখল করেন। মুসলিম লীগ ও প্রতিক্রিয়াশীল সব প্রতিষ্ঠান এই কুৎসিত অপকর্মকে স্বাগত জানায়।
প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থের অবস্থানকেই এ নিষ্কণ্টক করতে চায়। এই বাংলার ওপরও তার দখল প্রবলভাবে জারি হয়। সুবিধালোভী মোসাহেব জুটতেও দেরি হয় না। কিন্তু আপন অবস্থানে অটল থাকেন শেখ মুজিবুর রহমান।
সামরিক শাসনে দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ। শুধু সেটুকুতেই অনুমোদন, যাতে থাকে সেপাই রাজের স্তবগান। এদিকে দুবছর আগে শেখ মুজিবের উদ্যোগে আওয়ামী লীগ প্রশাসনে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্বের বিরোধিতা করে একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করে। তা থেকে তারা সরে আসে না। খেসারত তো তার জন্যে দিতেই হয়। ওই বছরের (১৯৫৮) ১১ অক্টোবর নিবর্তনমূলক আদেশে তাঁকে আটক করে একের পর এক মিথ্যা মামলা চাপিয়ে তাঁকে বন্দি রাখার পালা অবিরাম চলে। ১৯৬০-এর শেষে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে তাঁর মুক্তি জোটে। আইয়ুববিরোধী জনমত ও গণআন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি গোপন তৎপরতাও শুরু করেন। নিকৃষ্ট শাসন ও শোষণ থেকে মুক্তি পেতে পূর্ণ স্বাধীনতার বিকল্প যে কিছু থাকছে না, এ-কথাও তাঁর মনে হয়। তবে এটাও মাথায় রাখেন, গণচেতনায় তা তখনো নিরাকার এবং প্রত্যক্ষ সংগ্রামে যাবার মতো বাস্তব পরিস্থিতি নিতান্তই অনুপস্থিত। সেপাই-রাজত্বে ডাণ্ডা-আইনে বাক্-স্বাধীনতা খণ্ডিত; প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ।
’৬২-র ফেব্রুয়ারিতে জননিরাপত্তা আইনে তিনি গ্রেফতার হন। তবে ২ জুন সামরিক শাসনের অবসান ও আইয়ুবখানি বুনিয়াদি গণতন্ত্র চালু করার বিধি ঘোষণার পর ১৮ জুন তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আবার শুরু হলে প্রথমেই তিনি এই জাল গণতন্ত্র প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবাদ জানান। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কিছু হয় না। আওয়ামী লীগ অবশ্য দৈনন্দিন কার্যক্রমে ফিরে আসে। তবে পাশাপাশি মধু জোগাড়ের লোভে আইয়ুব খানের নেতৃত্বে কনভেনশন মুসলিম লীগেও স্বার্থান্বেষী চক্র সারাদেশেই ভনভন করতে শুরু করে। ১৯৬৫-র পরোক্ষ নির্বাচনে আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে এই বার্তা শোনালেন, তিনি জনগণের নেতা। ফেউ বাহিনীর হুক্কাহুয়াতে কান ঝালাপালা হতে থাকে। ’৬৫-তে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ এনে শেখ মুজিবকে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে হাইকোর্টের নির্দেশে তিনি ছাড়া পান। অনুমান, আইয়ুব খানের সাজানো নির্বাচন যাতে ভণ্ডুল না হয়, সেই জন্যেই তাঁকে জেলে পোরা। এত প্রতিকূলতা তাঁকে দমাতে পারে না। তিনি বরং আরো জেদি হন; আর সবার ভেতরে লড়াইয়ের মানসিকতা জাগিয়ে তুলতে থাকেন। ’৬৬-র ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে বিরোধীদলসমূহের জাতীয় সম্মেলনে তিনি ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উপস্থাপন করেন। ১ মার্চ তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ৬ দফা দাবির পক্ষে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই বাংলায় গণসংযোগ সফর শুরু করেন। এই ৬ দফাতে আছে – ১. ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের অনুসরণে একটি ফেডারেল কাঠামোয় পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার অধীনে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা; ২. কেন্দ্রীয় ফেডারেল সরকারের সরাসরি অধীনস্থ বিষয় শুধু দেশ রক্ষা ও বৈদেশিক রাষ্ট্র সম্পর্ক; অবশিষ্ট সব বিষয় স্টেট অর্থাৎ, প্রাদেশিক সরকারগুলোর নিজ নিজ আওতায়; ৩. মুদ্রাব্যবস্থা ও মুদ্রানীতি প্রতিটি প্রদেশের আলাদা-আলাদা নির্ধারণ। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে অনিয়ন্ত্রিত মুদ্রা পাচার রোধ; ৪. প্রতিটি প্রাদেশিক সরকারের হাতে সকল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা আদায় ও ব্যবহারের অধিকার, ফেডারেল সরকারের প্রাপ্য অংশ সেখান থেকে সরাসরি কেন্দ্রে প্রেরণ; ৫. বৈদেশিক বাণিজ্যে আমদানি-রফতানি আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রতিটি প্রদেশের নিজস্ব এখতিয়ারে এবং ৬. পূর্ব পাকিস্তানের নিজস্ব প্যারামিলিটারি বা রক্ষীবাহিনী গঠন। দলের সভাপতি হয়েই তিনি এই বাংলার সর্বত্র ৬ দফার প্রচারে নামেন। সরকার নিশ্চেষ্ট বসে থাকে না। ওই এক বছরেই প্রথম তিন মাসে তাঁকে আটক করে আটবার। তিনি পরোয়া করেন না। বাস্তব অবস্থায় প্রতিটি দফার ন্যায্যতা গণচেতনায় সঞ্চারিত হতে থাকে। তাঁর ওপর জনসাধারণের আস্থা ক্রমাগত বাড়ে। জনপ্রিয়তা তাঁর আকাশমুখী হয়। পাশাপাশি ছাত্র-আন্দোলনেও গতি আসে। উপায়ান্তর না দেখে আইয়ুব-মোনেম চক্র তাদের জেল-জুলুম-নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধুর কার্যক্রম তাতে প্রবলভাবে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে থাকে। তাঁর ভাবমূর্তি তখন শুধু নেতার নয়, ত্রাতারও। মরিয়া হয়ে শাসকচক্র তাঁকে এক নম্বর আসামি করে ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে এক মিথ্যা অভিযোগপত্র সাজিয়ে জেলখানা থেকেই তাঁকে আবার গ্রেফতার করে সেনানিবাসে আটক করে রাখে। সহ-অভিযুক্ত ছিলেন সেনাবাহিনীর ও প্রশাসনের বাঙালি সদস্য কজন। কঠোর প্রহরায় ১৯ জুন ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরে তাঁদের বিচারকাজও শুরু হয়। তবে এতে ভীমরুলের চাকে যেন ঘা পড়ে। বিক্ষোভে ফেটে পড়তে থাকে বাংলার জনগণ। সেনাবাহিনী নামিয়ে কারফিউ দিয়ে বেপরোয়া গুলি ছুড়েও তাদের আর বাগে আনা যায় না।
এদিকে ১৯৬৯-এর জানুয়ারিতে ঢাকায় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১১ দফা দাবি নিয়ে তারা আন্দোলনে নামে। ৬ দফা দাবি তাতেও ছিল। বাকি কটি ছিল শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক বিষয়ে প্রগতিশীল পরিবর্তনের আশায়। তখন কাগজে-কলমে সেনাশাসন ছিল না, – যদিও মেকি গণতন্ত্রের আড়ালে তা-ই ছিল কার্যকর। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলন পথে নামে; আর তখনই প্রচ্ছন্ন সেনাশাসনের মুখোশ খসে পড়ে। ২০ জানুয়ারি ঢাকার রাস্তায় তাদের গুলিতে শহিদ হন ছাত্রনেতা আসাদ। শেখ মুজিবকে মুক্ত করার দাবি তো ছিলই। এবার যোগ হলো পাকিস্তানি অপশাসন থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষা। গোটা দেশে তা দাবানলের মতো ছড়ায়। ক্ষমতাসীনরা তা গায়ের জোরে নির্মূল করার চেষ্টা করে। কারফিউ দিয়ে জুলুম, ধর-পাকড়, খুন হয়ে দাঁড়ায় নিত্যদিনের ঘটনা। গণআন্দোলন একরকম গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। তাকে ঠেকাবার ক্ষমতা আর তাদের থাকে না। শেষ পর্যন্ত নতিস্বীকারে তারা বাধ্য হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি নিরুপায় অবস্থায় তারা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে। শেখ মুজিব কিংবদন্তি নায়কের মতো কারাগার থেকে নিঃশর্ত মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে আসেন। পরদিন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে গণমানুষের পক্ষে তাঁর সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। এই সভা উপস্থিত লাখ লাখ জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু’ নাম ঘোষণা করে। তখন থেকে এই নামটি একমাত্র তাঁর। ৫ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় তিনি পাকিস্তানের এই পূর্বাঞ্চলকে ‘বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত করার আহ্বান জানান। কোনো ফাঁকা আওয়াজে নয়। কারণ তাঁর পেছনে তখন এই অঞ্চলের বিপুল মানবসমুদয়। রাজনৈতিকভাবেও তিনি অন্তত এখানে চালকের আসনে। তাঁর প্রেরণায় গণআন্দোলনের অভিঘাতে দোর্দণ্ড প্রতাপ আইয়ুব খানের দর্প ধুলোয় লুটোয়। গোঁফ নামিয়ে লেজ গুটিয়ে তিনি যবনিকার অন্তরালে চুপসে যেতে বাধ্য হন। তবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন অথবা করতে বাধ্য হন আরেক সেনা মাস্তান ইয়াহিয়া খানকে। এছাড়া বোধহয় অন্য কোনো উপায় খোলা ছিল না। ততদিনে এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রকৃত ক্ষমতা সেনাচক্রের কুক্ষিগত। কায়েমি স্বার্থের অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব তার অঙ্গুলি হেলনে ওঠে-বসে। কোনো উপেক্ষা সে সহ্য করে না। এখনো অবস্থা বর্তমান পাকিস্তানে গুণগতভাবে ভিন্ন নয়।
তখন দেশব্যাপী ক্ষোভ ও অসন্তোষকে আয়ত্তে আনার একটা পথ খুঁজছিলেন ইয়াহিয়া খান। তিনি ঘোষণা করলেন, এক বছরের ভেতরে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের মাধ্যমে সাধারণ নির্বাচন হবে। নির্বাচনে বিজয়ীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সেনাবাহিনী সুবোধ বালকের মতো ব্যারাকে ফিরে যাবে। ক্ষমতার চাবিকাঠি তাদের হাতে না থাকলে তারা যে স্বেচ্ছায় তা কখনোই করে না, আজ পর্যন্ত আমরা তা বারবার দেখেছি। অবশ্য এখন যা পাকিস্তান, যেখানে সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে গৌরবের সঙ্গে যুদ্ধজয় ও লুণ্ঠন ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং যার শুরু অষ্টম শতকে, সেখানে গণচেতনায় এর বিরূপতা কখনোই প্রবলভাবে ফোটে না। বেসামরিক সরকার তৈরি হলে তাকে টিকে থাকতে হয় সেনাশক্তিকে সেলাম ঠুকে। বহিরাগত লিয়াকত আলী খান অন্যের ওপর তাঁবেদারি পছন্দ করতেন, যার প্রকাশ ঘটেছে একাধিকবার পূর্ব বাংলাকে হেয় করার নানা আচরণে। কিন্তু ভেতরের সরল সমীকরণে নজর দেননি। তার মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে নিজের প্রাণ দিয়ে। ইয়াহিয়া খান হয়তো ভেবেছিলেন, নাকের সামনে মুলো ঝুলিয়ে অবস্থাটা বাগে আনি। তারপর নির্বাচনের ফলাফল পাশার চালে দান দিয়ে জাতীয় পরিষদের সদস্যদের ভেতর ঝগড়া-ঝাঁটি বাধিয়ে উলটে দিতে কতক্ষণ। ভালো মানুষ সেজে জনসংখ্যার অনুপাতে দুই ইউনিটের সদস্য সংখ্যা স্থির করার দাবিও তিনি মেনে নেন। কারণ, তিনি জানতেন পাকিস্তানের একতা ও অখ-তার বুলি আউড়ে আপৎকালে সেনাশাসনের দাওয়াইটা তাঁর হাতে সব সময়েই আছে। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের পর এই চালই তিনি জান্তব আক্রোশে চেলেছিলেন।
তখন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি। তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক। সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে সম্পূর্ণ মানবিক দায়িত্বে জনসংযোগের কর্ম-কাঠামো তাঁরা রচনা করেন। লক্ষ্য পুরোটাই এই বাংলার মানবসমষ্টির কাছে তাদের নির্যাতন ও বঞ্চনার কথা তুলে ধরা; কীভাবে সরকারি বিধি-বিধানের সুযোগ নিয়েই এই অঞ্চলের সম্পদ পাচার হয়ে যায় অপরাংশের মুষ্টিমেয় ক্ষমতাবানদের হাতে, তা ধারাবাহিক তথ্য সাজিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া। ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ – এই শিরোনামে পোস্টার ছেপে আওয়ামী লীগের পক্ষে দেশের সর্বত্র দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়। সবই বাস্তব তথ্যনির্ভর। সাধারণ মানুষের চোখ খুলে যায়। এদিকে নির্বাচনের ঠিক আগ দিয়ে ১২ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে দশ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ও বিষয়-সম্পদের বিপুল ক্ষতিতে পাকিস্তানি শাসকদের তুমুল ঔদাসীন্যে গণঅসন্তোষ আরো বাড়ে। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারণা স্থগিত করে দুর্গত এলাকায় ত্রাণের কাজে হাত লাগাতে দলবল নিয়ে ছুটে যান। তিনি মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠেন। পরে ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে এখানে বরাদ্দ ১৬৯টি আসনের ভেতর ১৬৭টিই জিতে নেয় আওয়ামী লীগ। সাধারণ পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাতেই সরকার গঠনের অধিকার তিনি পান। ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সদ্যনির্বাচিত ওই দলের জনপ্রতিনিধিবৃন্দ অঙ্গীকারবদ্ধ হন।
কিন্তু পাকিস্তানের দখলদার শক্তি তা সফল হতে দেয় না। নানা ধানাই-পানাই করে তারা কালক্ষেপণ করতে থাকে, এবং জাতীয় সংসদে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে নানারকম টালবাহানা এখানে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ করে তোলে। একই সঙ্গে কোনো ঘোষণা না দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে সমরসজ্জার ব্যাপকতায় তাদের দুরভিসন্ধির ইঙ্গিত স্পষ্টতর হয়। প্রকাশ্যে চলে আলাপ-আলোচনার অভিনয়। এসব আওয়ামী লীগের ওপর স্নায়ুর চাপ বাড়াবার কৌশল ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
উত্তেজনার এই তুঙ্গপর্বে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব স্থৈর্যে-সাহসে পূর্ণ বিভায় উদ্ভাসিত হয়। জনগণও অতুল আস্থায় সাড়া দেয়। এমন পরিস্থিতিতেই আমরা পাই তাঁর ’৭১-এ ৭ই মার্চের ভাষণ। এমন বলিষ্ঠ-আবেগদীপ্ত কিন্তু সংযত, সাহসী ও সম্পূর্ণ বক্তৃতা বিরল। কোনো সাজানো-গোছানো লিপিবদ্ধ তৈরি ভাষণ এ নয়। সবটাই স্বতঃস্ফূর্ত, কিন্তু সুচিন্তিত। বাড়তি কথা একটিও নেই। কিন্তু বলবার কথা কিছুই বাদ পড়ে না। অখ- পাকিস্তানের মাটিতে দাঁড়িয়ে এ বক্তৃতা, যাতে স্বাধীনতা সংগ্রামের দ্ব্যর্থহীন আহ্বান আছে, বাঙালির অধিকারের সুস্পষ্ট ঘোষণা আছে, দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের দিকনির্দেশ আছে; কিন্তু কোথাও তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনার কোনো সুযোগ নেই। তিনি গোটা পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে নির্বাচিত সংখ্যাগুরু সদস্যের নেতা। সেই অধিকার তিনি বিস্মৃত হন না। তাঁর সব নির্দেশই সবার জন্য প্রযোজ্য। আমাদের এই ভূখণ্ডে সরাসরি প্রত্যক্ষে। অন্য খণ্ডের নাগরিকদের জন্যেও সমান জরুরি। সাড়া দেওয়া-না-দেওয়া তাদের ব্যাপার। আমরা কিন্তু সাড়া দিই। ৭ থেকে ২৫ মার্চ দেশের সব নাগরিক-কর্মকাণ্ড তাঁর ঘোষিত নির্দেশ অনুযায়ী অক্ষরে-অক্ষরে পরিচালিত হয়। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিও তা অমান্য করেন না। ভয়ে নয়, তাঁর ভাষণের অন্তর্নিহিত নৈতিক ও বিধিসম্মত অনুজ্ঞায়। তাঁর সংগ্রামী প্রতিভা এই সময়ে শিখর স্পর্শ করে। পরবর্তী কটি বছর তারই অনুসরণ। অবশ্য বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্নতর। দ্বান্দ্বিক প্রেক্ষাপট অনচ্ছ। তিনি নির্ভর করেন আপন মনোভূমিতে জাগ্রত কল্যাণচিন্তা ও সদিচ্ছার ওপর।
চার
২৫ মার্চ রাতে অস্ত্রে-বর্মে সুসজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শুধু ঢাকায় নয়, অন্যত্রও নিরীহ-নিরস্ত্র বাংলার জনগণের ওপর হিংস্র উন্মাদনায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। গণহত্যার এই শুরু। আত্মসমর্পণ যদি না করি, তবে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণাই তখন একমাত্র বিকল্প। সেইসঙ্গে তখন হানাদার প্রতিহত করার সার্বিক প্রয়াস। জাতির তখন অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু দেশবাসীর আকাক্সক্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এবং প্রত্যাশিতভাবে দ্বিতীয়টিই বেছে নেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। … পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ টেলিফোন-বেতারে এই বাণী দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাৎক্ষণিক যতদূর সম্ভব প্রচারিত হয়। ওই রাতে পাক বাহিনীর আগ্রাসন তুঙ্গে। কিন্তু এই বাংলার মানুষ মাথা নত করে না। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর দৃপ্ত উচ্চারণ ছিল : ‘… রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। …’ এই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে এগিয়ে আসে উন্মুখ জাগ্রত জনতা। দুঃখবরণ, দুঃখভোগ, একটানা অনিশ্চিত উদ্বাস্তু জীবন, কিছুই তাদের মনোবল ভাঙতে পারে না। এদিকে অন্তঃসারশূন্য কাপুরুষোচিত দাপটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বীরপুঙ্গবেরা বঙ্গবন্ধুকে আটক করে তাদের খাসতালুকে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে রাখে। পাশাপাশি সামরিক ক্যাঙ্গাকোর্টে, যেখানে বাদী ও বিচারক একই সত্তার দুই অবতার, তাঁকে কাঠগড়ায় তুলে তাঁর মৃত্যু-পরোয়ানা জারি করে, যদিও বিরূপ আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় তা তাৎক্ষণিক কার্যকর করতে পারে না। আমাদের মুক্তিসংগ্রাম কিন্তু প্রত্যাশিত আধার পেয়ে যায়। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে বিপ্লবী সরকার ঘোষিত হয়। ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ায় মেহেরপুরের আম্রকাননে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিসভা সদ্যনির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে শপথগ্রহণ করে। তাতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধু স্থায়ী রাষ্ট্রপতি। মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গড়ে তোলার কেন্দ্রীয় দায়িত্ব থাকে এই সরকারের হাতে।
এদিকে দেশের ভেতরেও সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম বিভিন্ন এলাকায় স্বতঃস্ফূর্ত শুরু হয়। অভ্যন্তরীণ বশংবদ ঠেঙাড়ে বাহিনীসহ হানাদারদের ‘তেড়ে মেরে ডাণ্ডা করে দিই ঠাণ্ডা’ – নীতি বিফলে যায়। তাদের পাশবিকতার মাত্রা বাড়ে। কিন্তু ভেতর থেকে-বাইরে থেকে প্রতিরোধ ও প্রত্যাখ্যান তাদের মনোবল ভেঙে দেয়। মরিয়া হয়ে তারা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। স্থানীয় ঘাতক-দালালরা থাকে উৎসাহী সহায়ক অপশক্তি। ক্ষত ও ক্ষতি দুই-ই বাড়ে। প্রায় এক কোটি বাঙালি দেশছাড়া হয়। কিন্তু কেউ হাল ছাড়ে না। অবশেষে ৩ ডিসেম্বর শুরু হয় প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। একদিকে বাংলাদেশ ও ভারতের মিত্রবাহিনী, অন্যদিকে স্থানীয় সাগরেদদের নিয়ে সুসজ্জিত পাকসেনারা। দু-সপ্তাহ না পেরোতেই জবরদস্ত পাকবাহিনী ও তাদের স্যাঙাতদের ইতোনষ্টস্ততো ভ্রষ্ট অবস্থা। নিরুপায় হয়ে ১৬ ডিসেম্বর তারা পরাজয় মেনে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। পাকবাহিনীর তিরানব্বই হাজার সেনা তাদের সব হুকুমদারকে নিয়ে মিত্রবাহিনীর হাতে কয়েদ হয়। অবশেষে বাংলাদেশ মুক্ত। সরকার স্বাধীন ও সার্বভৌম। (যাঁদের জন্ম ১৯৭১-এর পরে, তাঁদের জন্যে এই কথাগুলো বলা। ’৭১-এর স্মৃতি যাঁদের আছে তাঁদের কাছে এ পুনরাবৃত্তি।)
পরিস্থিতি এমন, যেখানে বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষে ব্যবস্থা নেবার কোনো সুযোগই আর পাকিস্তানের থাকে না। তিনি এক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের বৈধ প্রধান। ওই রাষ্ট্রের স্বীকৃতিও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদিত। বিপরীতে সেনাপতি থেকে শুরু করে পদাতিক পর্যন্ত তিরানব্বই হাজার পাকসেনা মিত্রবাহিনীর হাতে বন্দি। বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে মুক্তি না দিলে তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে পাকিস্তান অনন্যোপায় হয়ে তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
সে-দেশেও ক্ষমতার সাময়িক রদবদল ঘটে। সামরিক শাসন উঠে যায়। বেসামরিক নির্বাচিত সরকারে জুলফিকার আলি ভুট্টো হন প্রধানমন্ত্রী।
বঙ্গবন্ধু লন্ডন ও দিল্লিতে যাত্রাবিরতি ঘটিয়ে ১০ জানুয়ারি ঢাকায় অবতরণ করেন। এ যেন আমাদের মুক্তিসংগ্রামের প্রধান কাণ্ডারির স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।
কৃতজ্ঞ জাতি তাঁকে বরণ করে নেয় ‘জাতির পিতা’ বলে। তিনি কিন্তু ফিরেই সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করতে চান। সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। তবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পর্বতপ্রমাণ বাধা। প্রধান প্রধান সড়ক, সেতু বিধ্বস্ত। শিক্ষাঙ্গন দীর্ঘদিন প্রায় অচল। লুণ্ঠনে ও অপচয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে তহবিল তলানির কোঠায়। জনগণের আশা বিপুল। ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ – এতদিন তারা তা জেনেছে। এখন সেই শোষণ নেই। লুণ্ঠন নেই। তাই প্রত্যেকেই হিসাব কষে আপন-আপন শ্রীবৃদ্ধির সম্ভাবনার। অতি প্রকটভাবে যাঁরা স্থায়ী নিয়োগে পদোন্নতির আশা করেন, তাঁদের ভেতর। এমনকি বিচার বিভাগেও। মুনসেফ আশা করেন জেলাজজ হবেন। জেলাজজ উঠতে চান হাইকোর্টে। (এমন কাউকে কাউকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সামনে তখন এ-জাতীয় আবদার করতে দেখেছি। অবশ্য ১৬ ডিসেম্বরের আগ দিয়ে)। আরো একটা সংকট তৈরি হয় মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা দেশান্তরি হয়ে পাকিস্তানি শাসনের সঙ্গে অসহযোগিতা করেছেন, এবং যাঁরা তখন দেশে থেকে যেতে বাধ্য হয়েছেন তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্কে। সংশয়ের বাতাবরণ একটা আপনা থেকে গজিয়ে ওঠে। অতি গভীরে থাকে আমাদের ওই প্রজন্মের হয়ে ওঠার ঐতিহ্য। ব্যক্তিস্বার্থও নাক গলায়।
এই অগোছাল সময়ে বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্য জনসভায় বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশে অন্তত তিন বছর তিনি কাউকে কিছু দিতে পারবেন না। সবার সম্মিলিত উদ্যোগে ও পারস্পরিক সহযোগিতাতেই কেবল এই আপৎকাল উত্তরণ সম্ভব। সকলের সহযোগিতা তিনি চান। বন্যার ঢলের মতো বাস্তব প্রবণতাগুলো কিন্তু সংযত হয় না।
আরো গভীর একটা অসুখ মুক্তিযুদ্ধের কারণেই কিন্তু সংক্রমিত হতে থাকে। যুদ্ধে যারা যোগ দেয়, তাদের অনেকের হাতে মারণাস্ত্র। যারা এর বিরোধিতা করে পটপরিবর্তনে তখন ঘাপটি মেরে থাকে, তাদেরও অনেকের হাতে। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দেন, অবৈধ সব অস্ত্র তারা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের হাতে যেন জমা দেয়। সামান্য অংশই তার জমা পড়ে। অস্ত্রের নিজস্ব একটা ধর্ম আছে। যার হাতে তা থাকে, তাকে তা প্রভুত্বকামী করে তোলে। এই প্রভুত্বের লড়াই তখন সামনে চলে আসে। দেশের ভেতর বিশৃঙ্খলা নানাদিকে ছড়ায়। এমনকি এলাকার দখল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদের ভেতরেও। স্বাধীনতাবিরোধীরাও ঘোলাজলে মাছ শিকারে মাতে। কোথাও কোথাও রাষ্ট্রকে উপেক্ষা করে মুক্তাঞ্চল ঘোষিত হয়। সাধারণ মানুষ দিশেহারা। উপায়ান্তর না দেখে স্বল্পশিক্ষিত সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাধিকার দিয়ে বঙ্গবন্ধু রক্ষীবাহিনী গঠন করে তাকে মাঠে নামাতে বাধ্য হন। এর ফল সব জায়গায় ভালো হয় না। অনেকের ভেতর বিরূপতা জাগে। তবে মনে রাখা সংগত, রক্ষীবাহিনী গড়বার দাবি ছয় দফাতেই লিপিবদ্ধ ছিল। সার্বিক সদিচ্ছারই প্রকাশ ঘটে একে গড়ে তোলায়।
প্রকৃতির বিরূপতাও একটা ব্যাপার। তিয়াত্তর-চুয়াত্তর, পরপর দুবছর কাটে খরায় ও বন্যায়। আশানুরূপ ফসল মেলে না। আবার নির্ভরতা বাড়ে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর। সুযোগ বুঝে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মোক্ষম চাল চালে। কিউবার সঙ্গে বাংলাদেশ বন্ধুত্ব করছে এই অজুহাতে তাদের খাদ্য সরবরাহ-জাহাজের মুখ তারা মাঝদরিয়াতেই ঘুরিয়ে দেয়। বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ এড়ানো যায় না।
আর একটা সংকট প্রকট হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে; সূত্রপাত কিন্তু আরো আগে আইয়ুব-মোনেম জামানায়। ছাত্রসমাজে দখলদারি বিস্তৃত করার লক্ষ্যে ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফ্রন্ট (এনএসএফ) নামে একটা পেটোয়া বাহিনী তারা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে বাড়তে দেয়। অলিখিত নির্দেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পড়ুয়া সন্তানরা তাতে ভিড়তে বাধ্য হয়। আসল ক্ষমতা থাকে এক মাফিয়া চক্রের দখলে। তাদের বিরোধিতা কেউ করলে তাকে মারপিট-নির্যাতন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। শুরু ’৬২-তে মার্শাল ল তুলে নেবার পর থেকে। চরমে ওঠে ’৬৪-৬৫-তে। ’৬৯-এর ১১ দফাকেন্দ্রিক সংগ্রামী ছাত্র আন্দোলনে তারা বুদ্বুদের মতো হাওয়া হয়ে যায়। কিন্তু জোর যার মুল্লুক তারের যে সংস্কৃতি তারা চালু করে, তা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। স্বাধীনতার পর মারণাস্ত্রের ঝনঝনানিরও শুরু। শাসকশক্তির আনুগত্যই সেখানে নিয়ন্তার ভূমিকায়। যদিও দখলদারির প্রতিযোগিতায় সেখানে অন্তর্দলীয় কোন্দলও প্রকট। ভোলা যায় না ওই সময়ে এক ছাত্রনেতার নির্দেশে একই দলের অভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষ সন্দেহে সাতজন ছাত্রকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে মেরে ফেলার ঘটনার কথা। ওই ছাত্রনেতা অবশ্য পরে সমর শাসনের কালে সেনানায়কের কাছে দাসখৎ লিখে তাঁর দলে যোগ দেন। একটু খুঁটিয়ে দেখলে ওই সময়ের এমন ছাত্র আরো চোখে পড়বে।
বাস্তব অবস্থা যখন এমন, তখন বঙ্গবন্ধু অনুভব করেন, সংসদীয় গণতন্ত্র এই পরিস্থিতিতে লক্ষ্যে পৌঁছুবার জন্যে যথেষ্ট উপযোগী নয়। তিনি মনে করলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সব শক্তিকে একত্র করে মিলিত চেষ্টায় অগ্রসর হলে হয়তো সুফল মেলা সম্ভব। তাতে যদি একক আওয়ামী লীগের বিলুপ্তি ঘটে, তবুও। তাই পঁচাত্তরের শুরুতেই তিনি রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা ঘোষণা দেন; এবং ২৫ জানুয়ারি স্বয়ং রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি সব রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘোষণা করে প্রগতি ও সমতার পক্ষে যাঁরা, তাঁদের সমন্বয়ে একটি মাত্র সংগঠন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠনের বার্তা দেন।
প্রকৃতপক্ষে এ একদলীয় নয়, একাভিমুখী যৌথ শাসন। কিছুদিন আগে তাঞ্জানিয়ায় জুলিয়াস নায়ারের রাষ্ট্রশাসনে এ-রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। আরো আগে যুগোশ্লাভিয়ায় মার্শাল টিটোও এই পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। তাঁর উদ্যোগের পরিণতি কী হতে পারত, আজ সে নিয়ে শুধু জল্পনা-কল্পনাই সার। কারণ ওই বছরের ১৫ আগস্ট ঘটে ইন্দ্রপতন। সামরিক বাহিনীর ভেতর থেকে এক অভ্যুত্থানে সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। শুধু তাঁর দুই কন্যা বাইরে থাকায় রেহাই পান। নিহত হন সপরিবারে তাঁর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি। একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটে। তবে ওই উদ্যোগ (বাকশাল) দুঃসাহসী ছিল কি না এবং তা বিশ্বের আর্থ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় সময়োচিত ছিল কি না, এসব প্রশ্ন করাই যায়। যদিও সবই পশ্চাদ্দৃষ্টিতে সম্ভাবনার বিচার-বিশ্লেষণ। এবং আবশ্যিকভাবে অসম্পূর্ণ। তবে সরষের ভেতরেই যে ভূত ছিল এ তো সাদাচোখেই দেখা যায়। খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, দুজনই ছিলেন বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। তাঁদের হিংস্র বাংলাদেশ-বিদ্বেষের আরো পরিচয় মেলে ওই বছরই ৩ নভেম্বর ঘাতকদের জেলখানার ভেতরে ঢুকে মুক্তিযুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার তিন সদস্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নৃশংসভাবে হত্যা করার অনুমতি দেওয়ায়। বহুরূপী আরো কতজন ছিলেন, তা কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায়। তবে আক্ষেপ কিছুতেই যায় না, যখন জানতে পাই সেনাবাহিনীর এক হন্তারকের নিত্য যাতায়াত ছিল বঙ্গবন্ধুর বাসগৃহে, – এবং তা তাঁর ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদে। এটা তো ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে হবার কথা নয়, উৎস নৈর্ব্যক্তিক সামষ্টিক অস্বীকার। এমন অমানবিক ঘৃণার বসতি এখনো এদেশে আছে। কখনো সুযোগ পেলে ছোবল দেয়; কখনো বা কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘাপটি মেরে থাকে। সুযোগ অবশ্য তৈরি করি আমরাই। লোভের রাজ্যে পৃথিবী সুযোগময়। যার যার মতো তাই খুঁজি। নইলে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে যিনি রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হয়েছিলেন, পরে তিনি বিএনপির পক্ষে সংসদ সদস্য হতে যাবেন কেন?
বঙ্গবন্ধু যে নির্মম হতে পারেন না, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কল্যাণের কথা মনে করেও এবং তাঁর প্রবাদতুল্য স্মরণশক্তি, যে-বিষয়ে তিনি নিজেও সচেতন ছিলেন, দুটো বিরল সৎগুণই কিন্তু প্রকারান্তরে তাঁর বিপক্ষে যায়। অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগে শিক্ষানবিশির সময় তাঁর সহযোদ্ধা ছিলেন অনেকে। পরে যে-দলই করুন তাঁদের ব্যাপারে তাঁর দুর্বলতা আগের মতোই থেকে যায়। অথচ তারা একেকটি বিষধর সাপ। খোন্দকার মোশতাকের কথা আগেই বলেছি, এছাড়াও ফজলুল কাদের চৌধুরী, খান এ সবুর, শাহ আজিজুর রহমান ও এই রকম আরো অসংখ্যজন তাঁর উদারতার সুযোগ নেন বারবার। কলকাতা জীবনে তাঁদের পারস্পরিক যোগাযোগ। তাঁর স্মরণশক্তি স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁদের ওপর তাঁকে কঠোর হতে দেয়নি। অপশক্তির শিকড় আলগা হয় না। দেশ কিন্তু তার দাম দেয়।
অথবা এমনও হতে পারে, জনগণ যে তাঁকে ‘জাতির পিতা’র মর্যাদা দিয়েছে, তিনি হয়তো (‘হয়তো’ই, কোনো বাস্তব তথ্য-প্রমাণ আমার হাতে নেই) তার সমস্তটার যোগ্য হয়ে উঠতে চেয়েছেন। মনে আছে, শিক্ষাঙ্গনে ও দেশের কোনো কোনো স্পর্শকাতর প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ওই সময়ে যখন অস্থিরতা দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে, তখন ঢাকায় এক বৃহৎ জনসভায় তিনি আবেগরুদ্ধ স্বরে তিরস্কারের ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমারে জাতির পিতা বানাইছ। আমার কথা তোমাদের শুনতে হবে। ওইসব বাড়াবাড়ি আর করবে না। নইলে …।’ এ যেন এক গোষ্ঠীপিতার বাইবেলীয় অনুজ্ঞা। সুযোগসন্ধানী অনুসারীরা তাঁর কথা শোনেনি। তিনি কিন্তু কঠোর হতে পারেননি। ‘পিতা’ তো তিনি ভালো-মন্দ মিলিয়ে সমগ্র জাতির।
তবে যুগান্তকারী জাতীয় বিপ্লব ও উত্থানের কালে এমন বিয়োগান্ত পরিস্থিতি ব্যতিক্রমী নয়। বিপুল আশা ও তা পূরণে নানা বাধা-বিপর্যয় মানব অভিজ্ঞতায় বারবার আসে। সংশ্লিষ্ট জনসমুদয়কে সাধারণ-স্তরে টেনে নামায়। যে ফরাসি বিপ্লব মানব সম্ভাবনার নতুন পথ খুলে দেয়, কিংবদন্তিতুল্য তার সব অধিনেতাই পরের দশ বছরে পারস্পরিক বিরোধে গিলোটিনে কাটা পড়েন। রুশ বিপ্লবের ইতিহাস কম শোচনীয় নয়। গৃহযুদ্ধ, পরে স্ট্যালিনের উত্থান বিপুল নিস্তব্ধ হাহাকারের জমাট স্তূপ ভবিষ্যতের কাঁধে চাপিয়ে যায়। বিপ্লব তার সব সন্তানকে গিলে খায় – এমন প্রবাদের বাস্তব উদাহরণ যেন এসব। বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে ঔপনিবেশিকতার অবসানের কালে প্রায় সব দেশে অবিসংবাদী জাতীয় নেতাদের ভাগ্যে জুটেছে অসম্মানের অবসান। ইন্দোনেশিয়ায় জেনারেল সুহার্তোর অভ্যুত্থানে ঘটে জাতির জনক সোকার্নর অপমানজনক বিদায়। আলজেরিয়ার অসাধারণ স্বাধীনতাসংগ্রামী বেন বেল্লা ও বেন খেদ্দাও বিতাড়িত হন স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্তে। কঙ্গোর জাতীয়তাবাদী নেতা প্যাট্রিস লুমুম্বা তো নিশ্চিহ্ন হন স্বাধীনতা অর্জনের মুহূর্তেই। আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ইতিহাস আরো নির্মম, নিষ্ঠুর কৃতঘ্নতায় ও বঞ্চনায় আকীর্ণ। জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবের কথা তো আরো করুণ। বর্ণবৈষম্যবিরোধী আপসহীন স্বাধীনতাসংগ্রামী জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে রাষ্ট্রপতির আসনে বসেন প্রায় তিন দশক আগে। অসমর্থ হয়ে পড়লেও গদি আঁকড়ে থাকেন। শেষ পর্যন্ত গত বছর তাঁর দেশের জনগণই তাঁকে টেনেহিঁচড়ে নামায়। আমাদের বঙ্গবন্ধু কখনো আত্মমর্যাদা হারাননি। ঘাতকরা যখন হানা দেয়, তখনো না। তাঁর নাম উচ্চারিত হয় আয়ারল্যান্ডের ডি ভ্যালেরা, কিউবার ফিডেল ক্যাস্ট্রো, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা বা চিলির আইয়েন্দের সঙ্গে সমলয়ে। তবে ইতিহাসের গতি কোথাও সরলরেখায় নয়। প্রতিটি কালবিন্দু নতুন। অতীতের প্রেরণা বা হতাশা তার সঙ্গী সন্দেহ নেই। কিন্তু ভবিষ্যতের দায় ও দায়িত্ব তার নিজের। আজ আমাদের প্রেক্ষাপট কেমন সেদিকে তাকানোও তাই জরুরি। এবং তা বঙ্গবন্ধুর কাছে আমাদের অশেষ ঋণের কথা মাথায় রেখেই।
বাস্তবের অতি সরলীকরণে অনেক সময় তার কাঙ্ক্ষিত রূপটি ফুটে উঠতে দেখি। তাতে তৃপ্তিও পাই। কিন্তু ভেতরের উলটাপালটা চোরা স্রোতগুলো আড়ালে চলে যায়, অথবা তাদের দেখতে চাই না। এতে আবেগ হয়তো আমাদের তুষ্ট হয়, অথবা তা ভেঙে পড়ে। কিন্তু তার পূর্ণস্বরূপ আড়ালেই থেকে যায়। ’৫৪-র প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটেছে, এখানে আর তারা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি, একথা আমরা খুব জোরের সঙ্গে বলে থাকি। কিন্তু মানুষের মনোজগতে ও আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় যে-শক্তির তারা প্রচ্ছদ ছিল, গঠনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় যাদের বিন্দুমাত্র উৎসাহ ছিল না, তাদের মূল ভেতর থেকে পুরোপুরি উৎপাটিত হয়েছে, একথা কি আমরা বুক ঠুকে বলতে পারি? আমরা দেখি ৯২-ক ধারা ততদিনই বলবৎ ছিল, যতদিন না যুক্তফ্রন্টের ভেতরে ফাটল ধরানো যায়। তাতে সফল হলে তারপরে তো বাজার বুঝে দান দিয়ে সময় মেপে ঘোড়ার হাতবদল। যুক্তফ্রন্ট রসাতলে যায়। ’৫৮-তে সোনার টোপর মাথায় দিয়ে আসলি চিজ বেরিয়ে আসে। তা আদি মুসলিম লীগের নতুন অবতার। দশ বছর রাজত্ব করে কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে ঘোষণা করে ‘ডিকেড অব রিফর্মস’। তাতে এ-অঞ্চলের ছিঁচকেদের কোমর দুলিয়ে নাচ দেখাতে তর সয় না। তবে সবকিছু ভেস্তে যায় ৬ দফা, ১১ দফার ডাকে। মুসলিম লীগ-পসন্দ ইমানদাররা ঘাপটি মেরে থাকে।
’৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুর ’৭২-এর সংবিধান তারা আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলে দিতে বিন্দুমাত্র দেরি করে না। মুসলিম লীগের নতুন অবতারদের হাত থেকে উদ্ধার পাবার পরও কিন্তু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমরা বাংলাদেশের আদি সংবিধানে পুরোপুরি ফিরে যেতে পারিনি। ফিরে যাওয়া নাকি সময়োচিত নয়। বোঝা যায়, মুসলিম লীগ এখনো আমাদের মনোজগতে একখণ্ড জমি আঁকড়ে পড়ে আছে। শুধু এখানে নয়, বিশ্বাসীদের সহিংস রাজত্ব অন্যত্রও।
আজকের বাংলাদেশ অনেককে আশান্বিত করে। জাতীয় আয়ে প্রবৃদ্ধির হার শতকরা সাতের ওপর। এটা উন্নয়নের লক্ষণ বই কি! মোট আয়ে সেবা খাতের দখলে শতকরা প্রায় বায়ান্ন ভাগ। শিল্প ও শিল্প-সম্পর্কিত খাত থেকে আসে শতকরা তিরিশের মতো। কৃষি ও কৃষিসংশ্লিষ্ট কাজ থেকে শতকরা আঠারো ভাগের এদিক-ওদিক। উন্নত অর্থনীতির লক্ষণ কিছু কিছু ফুটে ওঠে বই কি! কিন্তু জাতীয় কল্যাণের ছাপ তাতে পড়ে কি? সেবা খাতে আমাদের আয় বৃদ্ধি বহুলাংশেই কি উৎপাদনের গুণ ও পরিমাণগত পরিবর্তনের চেয়ে খরচের অপ্রয়োজনীয় অথবা লোকদেখানো খাত সৃষ্টি করে দ্রব্যগুণ অপরিবর্তিত রেখে তার দামে তারতম্য ঘটাবার ফল না? এতে মানুষের প্রকৃত তৃপ্তি কতটুকু বাড়ে? মানছি, কাজের পরিসর বড় হয়। এমনটি না হলে বেকারত্বের চেহারায় আমরা আতঙ্কিত হতাম। কিন্তু মূলে আমাদের সত্য সমৃদ্ধি কতটুকু হয়? দৈনন্দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর বেলাতেও প্রভাবশালী মধ্যস্বত্বভোগী চক্র প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এটাও আয় বাড়া সত্ত্বেও কল্যাণ না বাড়ার লক্ষণ। মানুষের মতিগতি বদলে যেতে থাকে। সবটাই তার শুভ নয়। কিন্তু অর্থনীতি ক্রমশ অশুভ শক্তির খপ্পরে চলে যাওয়া শুরু করে।
অপ্রয়োজনীয় ও বিপজ্জনক উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল অবশ্য পরাক্রমশালী দেশগুলোও। যুক্তরাষ্ট্রে মারণাস্ত্র খাতে উৎপাদন যদি বন্ধ হয়ে যায়, তবে গোটা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাই সেখানে ধসে পড়বে। নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনে সামান্য মারণাস্ত্রের ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আনাও সেখানে সম্ভব হয় না। এতে জনকল্যাণ কতটা বাড়ে, এ-প্রশ্ন তোলা কি অস্বাভাবিক? এসব প্রশ্ন অবশ্য বঙ্গবন্ধুর কালে আমাদের জন্য ছিল অবান্তর। সব মানুষ খেয়ে-পরে বাঁচুক, এই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। সেখানে তাঁর আন্তরিকতায় এতটুকু খাদ ছিল না।
একাত্তরে আমাদের জনসংখ্যা ছিল সাত কোটি। পাকিস্তানের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আমাদের হাতের একটি তুরুপের তাস। অন্যটি পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে রফতানি আয়। দুটোই কিন্তু আজ অবান্তর প্রায়। সহজলভ্য বিকল্পে বাজার ছেয়ে যাওয়ায় পাট আর আমাদের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক হাতিয়ার নয়। এদিকে জনসংখ্যা বেড়ে আজ ষোলো কোটি ছাড়িয়েছে, যদিও বৃদ্ধিহার কমে দাঁড়িয়েছে এখন বার্ষিক
১.৫-এর মতো। বিশ বছর পরে এই জনংখ্যা বিশ কোটি ছাড়াবে। জলবায়ু দূষণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করায় এর ভয়াবহ পরিণাম নিয়ে আমাদের কি কোনো ভাবনা আছে? বনখেকো-নদীখোকো চক্রের আগ্রাসন কিন্তু ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। সব শহরে পুকুর ও অন্যান্য জলাশয় ভরাট করে উঠছে বহুতল ভবন। বিশ বছর পর দেশ কি বাসযোগ্য থাকবে? বঙ্গবন্ধুকে মাথায় নিয়ে এর উত্তর খোঁজার দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই। কারণ মানুষ অতীত থেকে প্রেরণা পেলেও বাস করে বর্তমানে। দায় তার ভবিষ্যতের কাছে।
শুরুতে এই ভূমণ্ডলে কালযাত্রার একটা আভাস দেবার চেষ্টা করেছি। তাতে দেখেছি, কারণ যা-ই হোক মিশ্রণের ধারা এখানে বহমান। এবং সব ধারণাই অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিবর্তমান। উৎসে ফেরা জীবনের ধর্ম নয়। বরং উৎসারণে বিবিধ ভাবনার সংযোজন ও সমন্বয় তাতে গতি ও বিস্তার আনে। যখন এ-ভূভাগ ব্রিটিশ উপনিবেশ, তখনো। পাকিস্তান পর্ব পেরিয়ে ঘটে এখানে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। তাতে বৃহত্তর পরিমণ্ডলের চলমান ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি খণ্ডিত হয় না। বরং বাংলাদেশ তাতে নতুন মাত্রা যোগ করে। এই যোগ করায় নেতৃত্বে থাকেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর দ্বন্দ্বময় জীবনে থাকে তারই প্রতিফলন। তিনি মাথানত করেন না। অর্জিত মূল্য কিছু প্রত্যাখ্যানও করেন না। আমাদের বাংলাদেশের অণুতে অণুতে মিশে আছে যে-জীবনরস, তিনি তারই পূর্ণতা খোঁজেন। কোনো আপস করেননি। ব্যর্থও হননি। পরবর্তী প্রজন্মের এটিই মনে রাখবার। যদিও মুক্তমনে মূল্য সংযোজনের দায় তার নিজের। এই সংযোজন কিন্তু নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নয়। রাষ্ট্র ও ঐতিহ্য কদাচিৎ সমার্থক। আমরা দেখেছি, একমাত্র ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পর্ব ছাড়া কোনোকালেই পুরো উপমহাদেশ এক রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্য হয়নি। এতে বহুবৈচিত্র্য নিয়ে মানবসমুদয়ের দেওয়া-নেওয়ায় কোথাও কোনো বাধা পড়লেও তা স্থায়ী হয়নি। বহুমিশ্রণে আপন পরিচয় আলাদা চিনিয়ে দিয়ে এই বাংলাও তার অবদান সগৌরবে তুলে ধরতে পেরেছে। বঙ্গবন্ধু স্বয়ং তার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।
00 কালি ও কলম ( শিল্প সাহিত্য সাংস্কৃতিক বিয়ক মাসিক পত্রিকা) হতে সংগৃহিত।
Leave a Reply