জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি পরিবেশগত বিপর্যয়ের ফলে বিশ্বজুড়ে পানি সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ২.১ বিলিয়ন মানুষ নিরাপদ সুপেয় পানি সেবা থেকে বঞ্চিত। এ অবস্থায় ‘পানি ও জলবায়ু পরিবর্তন’ প্রতিপাদ্যে পালিত হচ্ছে (২২ মার্চ) বিশ্ব পানি দিবস। দিবসটির লক্ষ্য একবিংশ শতাব্দীতে পানি সংকট মোকাবেলায় প্রকৃতির সমন্বয়ে কিভাবে পানি ব্যবহারের উপযোগিতা বৃদ্ধি করা যায় তা খুঁজে বের করা এবং প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানে জনসচেতনতা বাড়ানো।
এ বছরের বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘পানি ও জলবায়ু পরিবর্তন’, যার অর্থ জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ সংক্রান্ত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে কয়েকটি হলো লবনাক্ততা, খরা, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রবলতা বেড়ে যাওয়া, হিমবাহ দ্রুত গলতে থাকা, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি বা হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি। এছাড়াও বেড়িবাঁধ ভাঙ্গন ও রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে উপকূলীয় এলাকার নিরাপদ পানির উৎসগুলো ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
গ্রীণহাউজ গ্যাসের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, পানির অপব্যয় বেশি হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ যেমন কমছে, তেমনভাবে পানি দূষণের বিবিধ কারণসমুহ গুরুতর হচ্ছে। কিন্তু এলাকা ভেধে এক এক এলাকার নিরাপদ পানির সমস্যা এক এক রকম এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা করে স্থানীয় জনগনের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করার জন্য এলাকার প্রয়োজন ও বাস্তবতার নিরিক্ষে পরিকল্পনা করা উচিৎ।
জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে বিশ্বের ১.২ বিলিয়ন মানুষ। ১.৮ বিলিয়ন মানুষ ভূমিক্ষয় ও মরুকরণ প্রক্রিয়া দ্বারা প্রভাবিত এবং কমপক্ষে ৬৫ শতাংশ বনভূমি ক্ষয়িষ্ণু পর্যায়ে রয়েছে। মানুষের পরিবেশবিরোধী কর্মকা-ের ফলে উনিশশ’ সাল থেকে শুরু করে বর্তমানে মোট জলাভূমির ৬৪ থেকে ৭১ শতাংশই হারিয়ে গেছে। কৃষি ভূমির মাটি ক্ষয়ের ফলে প্রতি বছর ২৫ থেকে ৪০ বিলিয়ন টন টপসয়েল বিলীন হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন ফলন কমে যাচ্ছে, অপরদিকে ভূ-উপরিস্থে প্রচুর পরিমাণ নাইট্রোজেন ও ফসফরাস থাকায় তা পানি দূষণে ভূমিকা রাখছে।
নদীতে পানি কমে যাওয়ায় বা না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীলতা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও প্রতিনিয়ত নিচে নেমে যাচ্ছে। এছাড়া, প্রকৃতি নির্ভর ধান চাষের পরিবর্তে খরা মৌসুমে সেচ ও রাসায়নিক সার নির্ভর ধান চাষের ফলে ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির সংকট ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে।
নদীভাঙন, উপকূলীয় বেড়িবাঁধের ভাঙন, বন্যা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাসে ঘরবাড়ি, সম্পদ হারিয়ে মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। বেড়িবাঁধের ভাঙন ও চিংড়ি চাষের কারণে উপকুলীয় এলাকায় পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সুপেয় পানির সংকটে রয়েছে উপকুলের ৯৫ শতাংশ মানুষ। নারীদের পানি সংগ্রহের জন্য ৪-৫ কিমি পাড়ি দিতে হয়। ২০ শতাংশ নারী লবণাক্ততার কারণে অকাল গর্ভপাতের শিকার হন; ৩ শতাংশ শিশু মারা যায়। পানি সংকটের কারণে পানিবাহিত সংক্রামক রোগ ডায়ারিয়া, কলেরার পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট, উচ্চ রক্তচাপের মতো অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তবে প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের মাধ্যমে পানি সংকটজনিত অধিকাংশ সমস্যা দূর করা সম্ভব। নদীমাতৃক এই দেশের নদ-নদী, খাল-বিল, হাওরসহ এর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, পরিষ্কার ও নিরাপদ পানি সরবরাহ জীববৈচিত্র্যের উপর নির্ভরশীল। জীববৈচিত্র্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় এবং দূর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খরা, বন্যা ও সুনামির মতো চরম বিপর্যয়ের প্রভাব হ্রাসে বনভূমি, জলাভূমি ও ম্যানগ্রোভ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই কঠোরভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ নদ-নদী, বনভূমি, জলাভূমি, পাহাড় প্রতিবেশ ব্যবস্থা সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের লক্ষ্যে অবিলম্বে ‘স্থানীয় অভিযোজন কর্মপরিকল্পনা’ প্রণয়ন করে পানি সংকটসহ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
পানি দিবসে জলবায়ু পরিষদের দাবিসমূহঃ
ক্স অবিলম্বে ‘স্থানীয় অভিযোজন কর্মপরিকল্পনা’ প্রণয়ণ করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবার জন্য পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে দরিদ্র ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এবং নারী ও শিশুদের প্রয়োজনের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।
ক্স উপক’লীয় অঞ্চলে বেড়িবাঁধের ভাঙ্গন রোধ করে সুষ্ঠ ও নিরাপদ পানি ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং ঝুকিমুক্ত বেড়িবাঁধের প্রয়োজনে বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে স্থানীয় সরকারকে যুক্ত করতে হবে।
Leave a Reply