বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে কৃষি, যা এ দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান প্রায় ১৫.৯৬% এবং ৪৭.৫% শ্রম শক্তি এ খাতে নিয়োজিত। এ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তাসহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা এখনও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল। বিবিএস ২০১৪-১৫ এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি ১০ লাখ এবং প্রতি বছর ২০ লাখ লোক জনসংখ্যায় যোগ হচ্ছে। ২০৪৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১.৩৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে হবে প্রায় ২২.৫ কোটি। এ বাড়তি জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা জোরদারকরণ আবশ্যক। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সামগ্রিকভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের কৃষি তথা সার্বিক জীবনযাত্রার ওপর। ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার আধিক্য, আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বিপদাপন্ন দেশ হিসেবে বিবেচিত। জলবায়ু পরিবর্তন এমন একটি বিষয়, যা সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করতে পারে। পৃথিবী সৃষ্টির আদিকাল থেকে পরিবর্তিত হচ্ছে জলবায়ু। এর প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও মানুষের ওপর। পরিবেশ, মানুষ ও জলবায়ু অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে আন্তঃসম্পর্কযুক্ত। আমাদের কৃষির সাথেও পরিবেশ, আবহাওয়া ও জলবায়ুর সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কৃষিক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে। ফলে পরিবর্তিত পরিবেশে বদলে যাচ্ছে এ দেশের খাদ্য ও কৃষি ব্যবস্থা। কৃষিতে সূর্যের আলো, তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতার মৌসুমভিত্তিক পরিবর্তনের সাথে সাথে ফসলের ধরন, জাত, চাষ পদ্ধতি ও উৎপাদনশীলতা নির্ধারিত হয়ে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের সময় ও পরিমাণে তারতম্য ঘটছে এবং এর প্রভাব পড়ছে ফসলের উৎপাদনশীলতার ওপর। এ কারণে দেশে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং হুমকির মুখে পড়ছে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা। পরিবর্তনশীল জলবায়ুতে এ দেশের জনগোষ্ঠীর পুষ্টিকর খাবার ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার জন্মলগ্ন ১৯৪৫ সাল থেকে প্রতি বছরের ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস পালিত হচ্ছে। এ বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাদ্য এবং কৃষিও বদলাবে। প্রতিপাদ্যটি নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা- প্রাকৃতিক কারণ ও মনুষ্য সৃষ্ট কারণ। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- সূর্যের শক্তি উৎপাদনে হ্রাস-বৃদ্ধি, মহাসাগরের উত্তাপ শক্তির পরিবর্তন, সমুদ্রশ্রুতের পরিবর্তন, মহাদেশসমূহের স্থান পরিবর্তন, আগ্নেয়গিরির দূষণ, এলনিনো ও লানিনা এর প্রভাব ইত্যাদি। মনুষ্য সৃষ্ট কারণ- শিল্প বিপ্লবের পর উনিশ শতকের সূচনালগ্ন থেকে জীবাশ্ম জ্বালানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন, কলকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া, বন উজার, জৈবিক পচন, কৃষিক্ষেত্রে সার ও কীটনাশকের অযাচিত ব্যবহারসহ বহুবিধ কারণে বায়ুম-লে বিভিন্ন প্রকার গ্যাস বিশেষ করে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস-অক্সাইড, সিএফসি গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সূর্য থেকে আগত তাপ রশ্মিকে পুনরায় মহাকাশে প্রতিফলিত হওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করে, ফলে পৃথিবী ক্রমাগত উষ্ণ হচ্ছে। আইপিসিসির সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় হুমকি জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর বিরূপ প্রভাব। এর প্রভাবে ভূম-লের জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ও এর গতি প্রকৃতিতে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে, আবহাওয়ার ধরন এবং ঋতু বৈচিত্র্য পাল্টে যাচ্ছে। বায়ুমণ্ডল এবং সমুদ্রের উষ্ণায়ন, বিশ্ব পানিচক্র, তুষারপাত, বরফগলা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ুজনিত দুর্যোগগুলোকে মানবসৃষ্ট প্রভাব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইন্টার গভার্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) তথ্যানুযায়ী জলবায়ুর পরিবর্তনে ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দুই-ই বাড়বে এবং অসম বৃষ্টিপাত হবে। আইপিসিসির ৫ম সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্ব গড় তাপমাত্রা ১-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির ফলে ফসল উৎপাদন, পানির প্রাপ্যতা, জীববৈচিত্র্য, তাপপ্রবাহ, অতিবৃষ্টি, উপকূলীয় জলোচ্ছ্বাস, বরফগলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ইত্যাদি প্রভাব পড়বে। বিশ্ব গড় তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তিতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক খাদ্য নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা একবিংশ শতাব্দীর শেষে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করবে ও বিশ্ব পানিচক্রে অসমতা পরিলক্ষিত হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি
বাংলাদেশের উত্তরে হিমালয় ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থাকার কারণে ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ সব সময়ই বিপদাপন্ন। বাংলাদেশের কৃষি মূলত আবহাওয়া ও জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃতি নির্ভর হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মাত্রাও কৃষি খাতে সবচেয়ে বেশি। ইউএনডিপি বাংলাদেশকে বিশ্বের এক নম্বর গ্রীষ্মম-লীয় সাইক্লোনপ্রবণ এবং ষষ্ঠতম বন্যাপ্রবণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অসম বৃষ্টিপাত, বন্যা, ভূমিক্ষয়, জলাবদ্ধতা, শুষ্ক মৌসুমে অনাবৃষ্টি, খরা, টর্নেডো, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাসের প্রাদুর্ভাব ও মাত্রা বৃদ্ধি, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি, শীত মৌসুমে হঠাৎ শৈত্যপ্রবাহ, ঘন কুয়াশা, আকস্মিক বন্যা ইত্যাদি এ দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে ক্রমাগত বিপর্যস্ত করে তুলছে, যা মানবকল্যাণ ও জনগোষ্ঠীর টেকসই জীবনযাত্রা এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিরূপ পরিস্থিতির সাথে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার সামঞ্জস্য বিধান করে জলবায়ু পরিবর্র্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কৃষিকে মুক্ত রাখা বা ঝুঁকি কমানো, দুর্যোগমুক্ত সময়ে শস্য বহুমুখীকরণ ও ফসলের নিবিড়তা বাড়িয়ে দুর্যোগের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া বিশেষভাবে বিবেচ্য। এ রকম অবস্থায় দেশের খাদ্য ও কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য, উপাত্ত এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন উপযোগী কলাকৌশল ও সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিত ও ক্ষয়ক্ষতি
বিগত ১০০ বছরে এ দেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ৫৮টি প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, ৫০ বছরে হয়েছে ৫৩টি বন্যা, তার মধ্যে ৬টি ছিল মহাপ্লাবন। ১৫৩ বছরে হয়েছে ২০টি বড় ধরনের ভূমিকম্প। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এ দেশে ছোট ও বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও কালবৈশাখীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬৭টি, তার মধ্যে ১৫টি ছিল ভয়াবহ। এতে সম্পদের ক্ষতি হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা (বিএমডি, ২০০৭)। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্র্রস্ত হয় কৃষি খাতই। বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের বন্যায় ৩২৫.৯ মিলিয়ন ডলার, ২০০৪ সালের বন্যায় আউশ ও আমন ফসলের ৪৩৫.৮৯ মিলিয়ন ডলারের খাদ্যশস্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং ১৯৮৮ সালে বন্যায় খাদ্যশস্যের ক্ষতি হয়েছিল প্রায় ২৫ লাখ টন। নভেম্বর ২০০৭ এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ তার গতিপথে উপকূলের ১৮৬,৮৮৩ হেক্টর ফসলি জমি সম্পূর্ণভাবে ৪৯৮,৬৪৫ হেক্টর আংশিকভাবে ক্ষতিগ্র্রস্ত হয়েছে এবং আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ হয়েছে ৩ বিলিয়ন ডলার (বিএমডি, ২০০৭)। শৈত্যপ্রবাহের ব্যাপ্তিকালের জন্য মানুষের জীবন ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে খরার কারণে বিগত ৫০ বছরে ২০ বার দেশ খরার ঝুঁকিতে আক্রান্ত হয়েছে এবং তীব্রতাভেদে আমনসহ অন্যান্য ফসল ২০-৬০% ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত খরার কারণে প্রায় ২১.৮ লাখ টন ধান নষ্ট হয়েছে।
কৃষির ওপর মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব
উপকূলীয় অঞ্চল এবং দূরবর্তী দ্বীপসমূহের ১.৪ মিলিয়ন হেক্টর এলাকায় লোনাপানি প্রবেশ করার ফলে উন্মুক্ত জলাশয় ও ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। প্রায় ১০.৫৬ লাখ হেক্টর চাষযোগ্য জমি লবণাক্ততার বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্র্রস্ত হয় (মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ২০০৯)। লবণাক্ততার কারণে এসব অঞ্চলের বিশাল পরিমাণ আবাদি জমি পতিত থাকে। শুষ্ক মৌসুমে নিয়মিত সামুদ্রিক জোয়ারের সাথে ভূ-ভাগের অনেক গভীর মিঠাপানি অঞ্চলে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে নদীর পানিকে আউশ ধান ও অন্যান্য আগাম খরিফ ফসলে সেচের কাজে ব্যবহারের অনুপোযোগী করে তুলছে।
কৃষির ওপর উষ্ণতা বৃদ্ধি, উষ্ণ ও শৈত্যপ্রবাহের ক্ষতিকর প্রভাব
আশংকা করা হয় যে, বাংলাদেশে ২০৩০ সাল নাগাদ গড় তাপমাত্রা ১.০ ডিগ্রি, ২০৫০ সালে ১.৪ ডিগ্রি এবং ২১০০ সালে ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। সম্প্রতি দেশে উষ্ণ ও শৈত্যপ্রবাহের মাত্রা বেড়েছে। বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে শীতকালের ব্যাপ্তি ও শীতের তীব্রতা দুই-ই কমে আসছে। বেশির ভাগ রবি ফসলেরই স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়ে ফলনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া শীত মৌসুমে উষ্ণ প্রবাহ দেখা দিলে বেশি সংবেদনশীল ফসল যেমন গমের ফলন খুব কমে যায় এবং উৎপাদন অলাভজনক হয়। ধানের ক্ষেত্রে ফুল ফোটা বা পরাগায়নের সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার ওপরে গেলে চিটার সংখ্যা বেড়ে গিয়ে শিষে ধানের সংখ্যা কমে যেতে পারে, যা ধানের ফলনকে কমিয়ে দেবে। ধানের কাইচ থোড় আসার পরপরই রাতের তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং দিনের তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে এবং এ অবস্থা ৪/৫ দিন অব্যাহত থাকলে ধান আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে চিটা হওয়ার আশংকা থাকে। ধানের প্রজনন পর্যায়ে বাতাসের গড় তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে ধানগাছের জন্য খুবই অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় এবং ধানে অতিরিক্ত চিটা হয়। শৈত্যপ্রবাহের সাথে দীর্ঘ সময় কুয়াশাচ্ছন্ন থাকলে অনেক ফসল বিশেষ করে গমের পরাগায়ন (পলিনেশন) ও গর্ভধারণ (ফার্টিলাইজেশন) না হওয়ায় আংশিক বা সম্পূর্ণ ফসল চিটা হয়ে যায় এবং পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যায়, প্রজাতি বৈচিত্র্য কমতে পারে এবং প্রজননে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। উষ্ণতা বাড়ার ফলে গাছের প্রস্বেদনের হার বেড়ে যায় এবং অতিরিক্ত সেচ প্রদানের ফলে সেচের পানির অভাব হয়। শৈত্যপ্রবাহের ফলে আমের মুকুল নষ্ট হয় ও নারিকেলের ফলধারণ ব্যাহত হয়।
জমির উর্বরতা হ্রাস
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষিক্ষেত্রে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতাসহ কৃষি পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে জমির উর্বরতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে ফসলের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। যদিও পলির পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে কোথাও কোথাও ভূমির ব্যবহার উপযোগিতা বৃদ্ধি পায় কিন্তু ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় এ লাভ অপ্রতুল।
কৃষির ওপর ঘূর্ণিঝড়/সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসের ক্ষতিকর প্রভাব
সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে মুহূর্তের মধ্যেই আক্রান্ত এলাকার ফসল, বৃক্ষরাজি, পশুপাখি, জীবজন্তু, ঘরবাড়ি ও মানুষসহ সবই ধ্বংস হয়ে যায়। প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন ‘সিডর’ এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
কৃষির ওপর নদীভাঙন ও ভূমি ক্ষয়ের ক্ষতিকর প্রভাব
নদীভাঙনের ফলে প্রচুর উৎপাদনশীল জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়। প্রতি বছরই নদীর কূল ভেঙে অনেক কৃষি জমি, বসতি স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। কৃষি জমি কমে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং নদীর দুই-কূলবর্তী অসংখ্য মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব ভাসমান মানুষে পরিণত হচ্ছে। পাহাড়ি এলাকায় অতিবর্ষণের সময় উঁচু এলাকার উপরিভাগের উর্বর মাটি ধুয়ে ক্ষয়ে যায়, কখনও কখনও ভূমি ধস হয়। ফলে এসব এলাকার মাটি ক্রমান্বয়ে উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ধীরে ধীরে ফসল উৎপাদনের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্য
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মরুকরণসহ অন্যান্য কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। ফলে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের বিলুপ্তি ঘটছে।
ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা
বাংলাদেশ সরকার ন্যাশনাল এডাপটেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন ২০০৫, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান ২০০৯, এর ধারাবাহিকতায় নিজস্ব তহবিলে ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠন করা হয়েছে। জলবায়ু অভিযোজন কার্যক্রমে বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্তির জন্য ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্ট ফান্ড’ গঠন করা হয়েছে। এর আলোকে কৃষিক্ষেত্রে দুর্যোগ ও জলবায়ু ঝুঁকি হ্রাসে পরিবর্তিত জলবায়ুতে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী কলাকৌশলের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে, যার ফলে জনগণের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ শক্তিশালী হবে। এ লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষি ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে, যার ফলে দুর্যোগপ্রবণ স্থানীয় জনগোষ্ঠী ভালোভাবে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে এবং ঝুঁকি মোকাবিলায় অধিকতর সক্ষম হয়ে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০১৬ উপলক্ষে প্রকাশিত ‘কৃষিকথা’ প্রকাশনাটি খাদ্য ও কৃষি উৎপাদনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষি ও কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের নীতি ও পরিকল্পনা
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি সমন্বিত উদ্যোগ এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা, সুশীল সমাজ ও ব্যবসায় খাতের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রভাব এবং সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্যের মধ্যেকার সম্পর্ক অনুধাবনের জন্য একটি নীতি গবেষণা ও বিশ্লেষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ সমীক্ষার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য হ্রাসের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা দিতে পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়নে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুগুলোকে সম্পৃক্ত করা। বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে ‘জলবায়ু পরিবর্তন সেল’ গঠন করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন সেলের কাছে বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজনের লক্ষ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুগুলোকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষমতা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
কৃষি ক্ষেত্রে করণীয়
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রমাণিত ভালো অভিযোজন কলাকৌশলসমূহ মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করে জনগণের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন ও টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। কিছু ভালো প্রমাণিত অভিযোজন কৌশল উল্লেখ করা হলো-
● খরা এলাকায় সম্পূরক সেচের জন্য মিনিপুকুর ও পাতকুয়া (ডাগ ওয়েল) খনন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ;
● বোরো ধানে শুকনা বীজতলা তৈরির মাধ্যমে সুস্থ ও কোল্ড ইনজুরিমুক্ত চারা তৈরি;
● বন্যা, আকস্মিক বন্যা, খরা ও লবণাক্ততা থেকে রক্ষা পেতে স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন ধান/ফসলের চাষ;
● খরা এলাকায় স্বল্প পানির চাহিদা সম্পন্ন ফসলের (গম, মুগ, মাসকলাই, ছোলা, মসুর ইত্যাদি) চাষ;
● মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় কম্পোস্ট, খামারজাত সার, ভার্মিকম্পোস্ট ইত্যাদির ব্যবহার;
● ফেরোমেন ট্রাপের মাধ্যমে শাকসবজির চাষ;
● পানি সাশ্রয়ের জন্য এডব্লিউডি পদ্ধতিতে ধানক্ষেতে সেচ প্রদান;
● কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে ‘জলবায়ু পরিবর্তন সেল/দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সেল’ গঠন করার জন্য সরকারের নীতি ও পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা যাতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি হ্রাসে সব স্তরের সংশ্লিষ্টদের (কৃষক, অফিসিয়াল, নীতিনির্ধারক প্রভৃতি) এ বিষয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা;
● কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে আপদকালীন ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত তহবিল/দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা তহবিল’ গঠন করার জন্য সরকারের নীতি ও পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা;
● এলাকাভিত্তিক উচ্চমূল্য ফসলের (High Value Crops) আবাদ সম্প্রসারণ ও উপযোগী শস্যবিন্যাস অনুসরণ করা;
● জোয়ার-ভাটা এলাকায় বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সর্জান ও ভাসমান পদ্ধতিতে পদ্ধতিতে সবজি ও ফল চাষ, ঘেরের পাড়ে সবজি চাষ করা;
● চরাঞ্চলে, উপকূলীয় এলাকায় তরমুজ, বাঙ্গি, খিরা, বাদাম, ফেলন, সূর্যমুখী, ভুট্টা ইত্যাদি চাষ;
● মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় ভার্মিকম্পোস্ট, কম্পোস্ট, জৈবসার, সবুজ সারের উৎপাদন ও ব্যবহার; ভূ-উপরিস্থ পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা;
● দুর্যোগের পূর্বাভাসে আগাম সতর্ক বার্তা প্রদান;
● দুর্যোগপ্রবণ এলাকা উপযোগী ফসল উৎপাদন পঞ্জিকা তৈরি, বিতরণ ও অনুসরণের ব্যবস্থা করা;
● সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা;
● জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে দেশব্যাপী স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা/প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন;
● দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে এলাকা উপযোগী কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষকের মাঝে ভর্তুকির মাধ্যমে বিতরণ করা;
● কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে একটি সেন্ট্রাল নলেজ হাব তৈরি করা যেখানে অ্যাডাবটেশন ও মিটিগেশনের কৌশলসমূহ এবং আবহাওয়া ও জলবায়ু সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষিত থাকবে।
কৃষিবিদ মো. হামিদুর রহমান*
*মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
Leave a Reply