জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে একটা প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় লেখা পাঠিয়েছিল মেয়েটি। সেখানে শীর্ষ স্থান পাওয়ার পরে পরিবেশ আন্দোলনের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হল। কয়েক মাস আগেই, ফেব্রুয়ারি ২০১৮-য় আমেরিকার ফ্লোরিডায় স্কুলের ছেলেমেয়েরা মিছিল করে বলেছিল, আমরা স্কুলে ফিরব না। স্কুলে বন্দুকবাজের হামলা বন্ধ করতে দেশের আগ্নেয়াস্ত্র আইন আগে বদলাও। পড়ুয়াদের সেই প্রতিরোধ অনেকটা সাহস দিয়েছিল। স্টকহলমের নবম শ্রেণি গ্রেটা থুনবার্গ তাই প্রথমে সহপাঠীদের অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করল। সাড়া মিলল না তেমন। সে বারই সুইডেন দাবানলে পুড়েছে, গ্রীষ্মের তাপমাত্রা আড়াইশো বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। সামনে ভোট। গ্রেটা ঠিক করল, হাতে একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে একলাই রোজ সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে ধর্নায় বসবে। সেই ছবি পোস্ট করবে টুইটারে-ইনস্টাগ্রামে।
২০১৮-র অগস্ট থেকে ২০১৯ শেষ হয়ে এল। কিশোরী গ্রেটা এখন মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে টুইটারে টক্কর দিচ্ছে। গ্রেটা থুনবার্গ আর শুধু একটি বিদ্রোহের মুখ নয়, গ্রেটা নিজেই একটা বিদ্রোহ। ‘ফ্রাইডেজ় ফর ফিউচার’ আন্দোলন কর্মসূচিতে ২০১৮-র ডিসেম্বরে শামিল প্রায় ২০ হাজার পড়ুয়া। ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে সেই সংখ্যা পৌঁছেছে ৪০ লক্ষে। গ্রেটা এক বছরের জন্য স্কুলের পড়া মুলতুবি রেখে ছুটে বেড়াচ্ছে গোটা পৃথিবী। ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে বলছে, আমার শৈশব তোমরা নষ্ট করেছ। আমাদের ভবিষ্যৎও নষ্ট করছ। তোমাদের লজ্জা করে না?
>বিনুনি দোলানো ষোড়শীটিকে দেওয়ার মতো উত্তর নেই বড়দের কাছে। তাই তাঁরা মশকরায় নেমেছেন। তাবড় রাষ্ট্রনায়কেরা সন্তানসম একটি মেয়েকে নিয়ে নাজেহাল। কেউ বলছেন, আরে এত রাগ ভাল না! কেউ বলছেন, জগৎসংসারের জটিলতা তুমি কী বোঝ হে? পরামর্শ উড়ে আসছে, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে সিনেমা-টিনেমা দেখে এসো বরং! মাথা ঠান্ডা হবে।
বিলক্ষণ! ঠান্ডা মাথায় পৃথিবীর উত্তাপ বাড়তে দিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের প্রতি ক্রুদ্ধ গ্রেটা। ‘‘তোমরা যারা মানুষের অস্তিত্বকেই বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিয়ে এই সব ফাঁপা কথা বলো, তোমাদের আমরা ক্ষমা করব না।’’ তার কথার ঝোঁকে, চোখের তারায় ঠিকরে পড়ে অবিমিশ্র তেজ আর জেদ। সেই ক্রোধে এখনও মিশে যায়নি দুনিয়াদারির কলুষ। তাই প্রথম বিশ্বের একাধিক দেশকে মামলা ঠুকে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য চাপ দিতে তার সাহসে আটকায় না।
অথচ এই আগুনঝরানো মেয়েই ক’বছর আগে বিষাদের গহ্বরে ঢুকে গিয়েছিল। এগারো বছর বয়সে ধরা পড়ল অ্যাসপার্গার সিনড্রোম, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার আর সিলেক্টিভ মিউটিজ়ম। মাথায় চেপে বসল পাহাড়, আমি আর সবার মতো নই। গুটিয়ে গিয়ে চুপ করে গেল গ্রেটা। এই অসুখ যাদের, তারা নিজেরা না চাইলে কথা বলে না। গ্রেটা এখন বলে, ‘‘প্রয়োজন না হলে আমি তো কথা বলি না। এটা একটা প্রয়োজনীয় মুহূর্ত— তাই বলছি।’’
রোগের সঙ্গে লড়াই করে জয়ের নজির অপ্রতুল নয়। কিন্তু গ্রেটা যেন এগিয়ে গিয়েছে আরও একটা ধাপ। নিজের অসুখকে সে বদলে নিয়েছে নিজের শক্তিতে। অসুখের সঙ্গে লড়ার জেদকে বানিয়ে নিয়েছে পৃথিবীর অসুখ সারানোর ব্রতে।
এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যাওয়ার কথা ছিল যাঁদের, তাঁরা সে কাজে ব্যর্থ। তবু এই অসুস্থ, দূষিত পৃথিবীর সন্তান হয়েই কিন্তু নতুন শপথ নিয়ে উঠে আসছে গ্রেটারা। অন্ধকারই হয়তো বা জন্ম দিচ্ছে নতুন ফুলকির।
মশকরাবিদরা যা-ই বলুন, আন্তর্জাতিক নাগরিক সমাজের বড় অংশই মানছেন, গ্রেটা শুধু তারুণ্যের আবেগকেই সম্বল করেনি। তার সঙ্গে যথেষ্ট পরিণত বোধের স্বাক্ষরও রেখে চলেছে। পরিবেশের সঙ্কটকে যে অর্থনীতি আর রাজনীতি-বিযুক্ত ভাবে দেখা যায় না, অরণ্য নিধনের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে যে বনবাসী মানুষের জমিজিরেতের সংগ্রামের সঙ্গে জুড়তে হবে, সেই সচেতনতা তার আছে। তরুণ মার্কিন নেত্রী আলেকজ়ান্দ্রিয়া ওকাসিয়ো-কর্তেজ়’এর সঙ্গে কথা হয়েছে গ্রেটার। দু’জনের আলাপে ছিল নতুন কৌশলের সন্ধান। কমবয়সি বলে লাগাতার তাচ্ছিল্যের জবাব দেওয়ার কৌশল।
নিজস্বী-নিমগ্নতাকেই যাঁরা আজকালকার ছেলেমেয়েদের একমাত্র অভিজ্ঞান বলে মনে করেন, বর্ষশেষের এই লগ্নে তাই খানিকটা থমকাতে হচ্ছে তাঁদের। কারণ গ্রেটা যে ওই নতুন প্রজন্মেরই প্রতিনিধি। শুধু কি গ্রেটা? হংকংয়ে-ফ্রান্সে-চিলিতে বিক্ষোভের প্রথম সারিতে থেকেছে যারা, দিল্লির জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আঙুল তুলে পুলিশকে আটকাতে এগিয়েছে যে মেয়েরা— তারা সকলেই বয়সে নবীন। ঝানু মাথার দাপটের জবাবে ভরসা তা হলে ওই তারুণ্যই।
Leave a Reply