সেলিম হায়দার ॥
আব্দুল কাদের একজন মানষিক প্রতিবন্ধী । বয়স ৫৩ বছর। বাড়ী সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খেশরা ইউনিয়নের শাহাজাতপুর গ্রামে। পাইকগাছার রাড়–লিস্থ আর.কে.বি.কে হরিশচন্দ্র কলেজিয়েট ইন্সটিটিউট থেকে ১৯৮২ সালে মাধ্যমিক আর ১৯৮৫ সালে উপজেলার কপিলমুনি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর একই কলেজে ¯œাতক শ্রেণীতে অধ্যায়ন অবস্থায় আকষ্মিক মস্তিষ্কের বিকৃতি।
পারিবারিক সূত্র জানায়,সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খেশরা ইউনিয়নের শাহাজাতপুর গ্রামে শওকত আলী মোড়লের ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ের মধ্যে এম,এম আব্দুল কাদের সবার বড়। প্রথম থেকেই তাদের পারিবারিক স্বচ্ছলতা ভাল না থাকলেও শওকতের বিদ্যানুরাগী মনোভাব সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে অনুপ্রাণিত করে। সে লক্ষে এগিয়েও যাচ্ছিলেন তারা। বড় ছেলে আব্দুল কাদেরকে বাড়ীর অদূরবর্তী পাইকগাছার রাড়–লীস্থ আর.কে.বি.কে হরিশচন্দ্র কলেজিয়েটে ইহ্নটিটিউটে ভর্তি করেন। সেখান থেকে ১৯৮২ সালে সুনামের সাথে মাধ্যমিক পাশ করার পর ভর্তি করান কপিলমুনি কলেজে। সেখান থেকে ১৯৮৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর ¯œাতক শ্রেণীতে ভর্তি হন একই কলেজে।
তবে ভাগ্য বিড়ম্বিত আব্দুল কাদেরকে আর এগুতে দেয়নি নির্মম নিয়তি। জমি-জমা সংক্রান্ত একটি পারিবারিক বিরোধ আকষ্মিক থমকে দেয় তার গতিময় জীবন। যার জের ধরে তারই এক চাচাতো ভাই তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাল কাঠের রুল দিয়ে নির্মম নির্যাতন করে। এতে সে প্রাণে বেঁচে গেলেও চরমভাবে মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটে তার। এরপর সর্বস্ব বিক্রি করে চিকিৎসায় সেবারের মত প্রাণে বেঁচে গেলেও আর ভাল হয়ে উঠেনি আব্দুল কাদের। বন্ধ হয়ে যায় তার পড়া-লেখা। এরপর কিছু দিন অন্তর অন্তর আকষ্মিক মাথায় গন্ডগোল,স্থানীয় চিকিৎসায় আবার ভাল হয়ে ওঠা। এলাকাবাসীর পরামর্শে পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত আসে হয়তো দাম্পত্য জীবনে মস্তিষ্কের সফলতা অসতে পারে।
বিয়েও দেয়া হয় তাছলিমা নামে এক মেয়ের সাথে। দাম্পত্য জীবনে এক মেয়ে ফাতেমার (বিবাহিত) জন্ম হয়। তবে মেয়ের জন্মের কিছুদিন পর তাছলিমার মৃত্যু ঘটে। নি:সঙ্গতায় ফের পাগলপ্রায় অবস্থা হয় তার। এরপর ফের তাকে জুলেখা নামে এক মেয়ের সাথে বিয়ে দেয়া হয়। নতুন করে দাম্পত্য জীবনে তাদের দু’কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। যার একজন আসমা খাতুন (বিবাহিত) ও অপর জন ফাইম খাতুন(৪)।
আব্দুর কাদেরর দাম্পত্য জীবন শুরু হলেও সুখের হয়নি।ছোট মেয়ে ফাইমার জন্মের পরেই একেবারেই বিগড়ে যান কাদের। স্বজনদের ধরে মারপিট,ভাংচুর ও প্রতিবেশীদের ক্ষতিসাধন শুরু করতে থাকেন। প্রতিদিন বাড়তে থাকে তার পাগলামি। এক পর্যায়ে পরিবারের সদস্যরা বাধ্য হয়ে তাকে প্রথমে বারান্দায় হাতে-পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা শুরু করেন। তবে,সারাক্ষণ উচ্চস্বরে চিৎকার ও অশ্লীল বাক্যবানে বিরক্ত হয়ে পরিবারের লোকজন বাড়ী থেকে প্রায় ৩ শ’ ফুট দূরে বাগানের মধ্যে গাছে বেঁধে রাখা শুরু করেন। বাবা-মা,স্ত্রী-সন্তানদের ফেলে এখন তার ঠাঁই হয়েছে,বাড়ির পাশের বাগানের মধ্যে অন্ধকার গর্তে। রাত-দিন ঝড়-বৃষ্টিতে এক হাত ও পায়ে শিকলে বাঁধা পড়েছে তার গদ্যময় নিঃসঙ্গ জীবন। সব আশা,আকাংখা,স্বপ্ন-সাধ আটকে গেছে আটো-সাটো একটি গর্ত ও তার উপর পড়ে থাকা একটি ছোট মেহগনি গাছের উপর। এভাবেই গত প্রায় ৪ টি বছর অন্ধকার গর্তেই নি:সঙ্গতায় কাটছে তার জীবন।
খবর পেয়ে বুধবার বিকেলে সরেজমিনে প্রতিবেদনকালে ঘটনাস্থলে গেলে চিরাচরিত স্বভাবেই দেখা যায় তাকে। তবে কথোপকথনে মোটেও মস্তিষ্ক বিকৃত বলে মনে হয়নি। প্রথম দেখাতেই সাংবাদিকদের দেখে সালাম দেন তিনি। তারপর একে একে তার জীবনের সব ঘটনার নির্ভূল বর্ণনা দিতে থাকেন। কখনো পুরনোকে মনে করে আবেগ আপ্লুত হতে দেখা যায় তাকে। এসময় তিনি তার শৈশব-কৈশোরের সব স্মৃতির রোমন্থন করতে থাকেন। তবে তাকে করা সব প্রশ্নের উত্তর দেন মধুর কন্ঠে শুরে শুরে। তবে কথার ফাঁকে ফাঁকে নিজের শিকলে বাঁধা জীবন থেকে ক্ষণিকের জন্য হলেও মুক্তির আকূতি জানান। আব্দুল কাদের বলেন,আপনারা জানেন? আমি আমার ৪ বছরের মেয়ে ফাইমাকে কখনো কোলে নেয়নি,আদর করা হয়নি কখনো তাকে। আমাকে দূর থেকে দেখেও ভয়ে পালিয়ে যায় বলে ফের কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।
এক পর্যায়ে তার সরল স্বীকারোক্তির নির্ভূলতা যাচাই করতে তার ঠিকানা জানতে চাইলে তিনি মুখে শুরে শুরে বলার পাশাপাশি খাতা-কলম চান লিখে দিতে। এরপর নির্ভূল ইংরেজীতে লিখেন তার বায়োডাটা। তবে কেন একজন সুস্থ্য-সবল মানুষকে ৪ বছর এভাবেই বেঁধে রাখা? এমন প্রশ্ন করতেই স্বজনদের কাদেরের মা ও স্ত্রীর মধ্যে শুরু হয় চোখাচোখি,কানাকানিসহ নানা ইশারা। যেন,কিছু একটা গোপন করতে চাওয়া। তবে কেন তাদের এই গোপনীয়তা? নাকি নিরবতা? মূহুর্তেই নানান কেন বার বার উঁকি দিতে থাকে।
একপর্যায়ে কাদেরের মা রহিমা বেগম (৭০) ছেলের উপর ঘটে যাওয়া নানা নির্যাতনের বর্ণনা শুরু করলে স্ত্রী জুলেখা তাতে বাঁধ সাধেন। যেন তাদের চোখে-মুখে তখন অন্য রকম এক ভীতি কাজ করছিল। কিছু একটা গোপন করতে চাইছেন তারা। তবে কথোপকথনের একপর্যায়ে মৃতপ্রায় কাদেরের একেবারে মৃত্যুর শঙ্কাটি বার বার সামনে এসে দাঁড়ায়। তবে কিসের সেই শঙ্কা ? ব্যাপক তথ্যানুসন্ধানে উঠে আসতে পারে তা।
এব্যাপারে কথা হয়,স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান প্রভাষক রাজিব হোসেন রাজুর সাথে। তিনি বলেন এমন অবস্থায় একজন মানুষ তার ইউনিয়নে নির্মম জীবন-যাপন করছেন তা তার জানা ছিলনা। সম্প্রতি স্থানীয় এক ফায়ার সার্ভিস কর্মী শেখ আরিফুর রহমান আজগরের সহযোগীতায় দেখতে যান তাকে। তাৎক্ষণিক যৎসামান্য সহযোগীতাও করেছেন। তবে আব্দুল কাদেরের জন্য ভবিষ্যতে কিছু করার মানষিকতাও পোষন করেন তিনি।
সর্বশেষ এমন পরিস্থিতিতে এলাকাবাসীর পাশাপাশি পরিবারের দাবি,সুচিকিৎসায় স্মৃতি ফিরতে পারে তার। ফিরে পেতে পারে তার স্বাভাবিক জীবন। তবে তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছার পাশাপাশি অনেক টাকা। এব্যাপারে তারা সরকারি-বেসরকারী পর্যায়ে সহযোগীতার জন্য সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
Leave a Reply