নিজস্ব প্রতিবেদক :
সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি মাসের ২০ তারিখ থেকে আগামী দুই মাস সাগরে মাদার (মা বাগদা) ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় ফের সংকটে পড়তে যাচ্ছে দেশের সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি শিল্প। সরকারি সিদ্ধান্তের এই সুযোগ নিয়ে একটি স্বার্থন্বেষী মহল ভারত থেকে অবৈধ পথে ভাইরাস যুক্ত নিম্মমানের নপ্লি (ছোট পোনা) দেশে এনে নাসিং করে বাজারে বিক্রির পায়তারা শুরু করেছে। ভারতীয় নপ্লি নাসিং করা ভাইরাস যুক্ত চিংড়ি পোনা ঘেরে ছাড়লে ক্ষতিগ্রস্থ হবে চাষীরা। ফলে হুমকির মুখে পড়বে দেশের চিংড়ি শিল্প।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য দপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার সাতটি উপজেলায় ৬৬ হাজার ৯১০ হেক্টর জমিতে ৫৫ হাজার ১২২টি ছোট বড় চিংড়ি ঘের রয়েছে। চলতি ২০১৯ মৌসুমে চিংড়ি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে ২৭ হাজার ৫শ’ মেট্রিক টন। এসব ঘেরে চিংড়ি পোনার চাহিদা রয়েছে ৩৩৪কোটি। চট্রগ্রাম ও কক্সবাজারে ৫৬টি এবং খুলনা অঞ্চলে ২৭টি মিলে দেশে মোট চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারি হ্যাচারী রয়েছে ৮৩ টি। এছাড়া নার্সারী রয়েছে ১৮২টি।
মোস্তফা শ্রীম্প প্রডাক্ট (ব্রান্ড-সৌদিয়া) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ্ব মোঃ কফিল উদ্দিন জানান, সাগরে এমনিতে মাদার সংকট চলছে। টাকা দিলেও মাদার মিলছে না। মাদার সংকটের কারনে কক্সবাজার ভিত্তিক চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারি অধিকাংশ হ্যাচারী ভরা মৌসুমে উৎপাদনে যেতে পারছে না। চট্রগ্রাম ও কক্সবাজার ভিত্তিক ৫৬টি হ্যাচারীর মধ্যে বর্তমানে ২১/২২ টি হ্যাচারী চালু আছে। এসব হ্যাচারীতে যে পরিমান পোনা উৎপদনে হচ্ছে তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। ফলে বাজারে এখন চিংড়ি পোনার সংকট রয়েছে। এরই মধ্যে সরকার চলতি মে মাসের ২০ তারিখ থেকে আগামী দুই মাসের জন্য সাগরে মাদার (মা বাগদা) ধারার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে মাদার ধারা বন্ধ থাকলে বাজারে পোনার সংকট আরো বৃদ্ধি পাবে। ফলে চিংড়ি চাষের ভরা মৌসুমে ঘেরে পোনা ছাড়তে না পেরে ক্ষতিগ্রস্থ হবে চাষীরা। একই সাথে ক্ষতিগ্রস্থ হবে দেশের চিংড়ি শিল্প। যার প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতির উপর। তিনি দেশের চিংড়ি চাষী ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থে সাগরে মাদার ধরা বন্ধ রাখার সরকারি সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনার দাবি জানান।
চিংড়ির সাথে সংশ্লিষ্ট একাধিক নির্ভরযোগ সূত্র জানায়, দুই মাস সাগরে মা বাগদা (মাদার) ধারা বন্ধ থাকার কারনে একমাস পরে বাজারে চিংড়ি পোনা সরবরাহ থাকবে না। আর কৃত্রিম পোনা সংকটের এই সুযোগে অবৈধ পথে ভারতীয় নিম্মামেনর নপ্লি ঢুকবে বাংলাদেশে। অধিক মুনাফা লাভের আশায় স্থানীয় কিছু হাচারী ও নার্সারীর মালিক অবৈধ পথে আনা নিম্মানের এই ভারতীয় নপ্লি নাসিং করে তা বাজারজাত করবে। ফলে ভাইরাস যুক্ত নিম্মামানের এই ভারতীয় পোনা বাজার থেকে কিনে প্রতারিত হবে চিংড়ি চাষীরা। এই পোনা ঘেরে ছাড়ার কিছুদিন পর মাছে মড়ক দেখা দেয়। ফলে এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ঘেরের সমস্ত চিংড়ি মরে সাবাড় হয়ে যায়।
সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশের চিংড়ি ঘেরে ভাইরাসের প্রদূর্ভাব শুরু হয়েছে স¤ভবত ভারতীয় নিম্মমানের পোনা থেকে। যা এখন দেশের চিংড়ি চাষ এলাকায় মহামারি আকার ধারণ করেছে। চিংড়ি ঘেরে ভাইরাসের কারনে সর্বশান্ত হতে বসেছে সাতক্ষীরা ও খুলনা অঞ্চলের অনেক চাষী। মা বাগদা ধরা বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্তের এই সুযোগ নিয়ে একটি স্বার্থন্বেষী মহল ইতিমধ্যে ভারতীয় নিম্মামানের নপ্লি আনার পরিকল্পনা করছে। গত কয়েকদিন আগে সাতক্ষীরা শহরের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এনিয়ে গোপন বৈঠকও করেছেন তারা।
বাংলাদেশ মৎস্যচাষী সমিতির সভাপতি সাবেক মৎস্য প্রতিমন্ত্রী ডাঃ আফতাবুজ্জামান জানান, চিংড়ি চাষের এই ভরা মৌসুমে মাদার ধরা বন্ধ থাকলে বাজারে পোনার সংকট দেখা দিবে। এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ভারত থেকে নপ্লি এনে তা বড় করে বাজারে বিক্রি করবে। এতে করে চাষীরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তাছাড়া ভারতীয় ব্যবসায়ীরা অবৈধ পথে সব চেয়ে নিন্মমানের নপ্লিটা বাংলাদেশে পাঠায়। যে কারনে এই পোনা ঘেরে ছাড়ার কিচুদিন পর ভাইরাসে আক্রন্ত হয়ে মারা যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় চাষীরা।
চাষী ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থে সাগরে মাদার ধরা বন্ধের সময়টা আরো পিছিয়ে দিতে হবে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, এই ক্ষেত্রে চিংড়ি চাষী, ব্যবসায়ী ও হ্যাচারী মালিকদের সাথে আলাপ আলোচনা করার দরকার ছিল।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম সরদার জানান, সাগরে দুই মাস মাদার ধরা বন্ধ থাকলে প্রথম একমাস ওই পেরা দিয়ে চলবে। তবে পরের এক মাস একটু অসুবিধা হবে। এসময়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে নিম্মমানের চিংড়ি রেনু, নপ্লি, পিএল ও চিংড়ি বিভিন্ন পন্থায় দেশের অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষে ব্যাপক মড়ক এবং রপ্তানী বন্ধের জন্য এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে বা যাচ্ছে। বিষয়টি দেশের ভামূর্তি ক্ষুন্ন করবে এবং চিংড়ি উৎপাদন ও রপ্তানীতে বির্পয় দেখা দিতে পারে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, বিদেশী চিংড়ি রেনু, নপ্লি, পিএল ও চিংড়ি সীমান্ত দিয়ে আমাদের দেশে অনুপ্রবেশ বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সাতক্ষীরাস্থ বিজিবি ৩৩ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক বরাবর চিঠি দেয়া হয়েছে। এই চিঠির অনুলিপি মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, বিজিবি ১৭ ব্যাটালিয়নের অধিনায়কসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দপ্তরে দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
Leave a Reply