ডেস্ক রিপোর্ট: নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে আল নূর মসজিদে হামলার পর হামলাকারী বেছে নিয়েছিল লিনউড মসজিদকে। নূর মসজিদের হামলায় ৪১ জনকে হত্যায় সমর্থ হলেও তার দ্বিতীয় হামলায় হতাহত্যের সংখ্যা তুলনামূলক কম। লিনউড মসজিদের হামলায় ৮ জনকে হত্যায় সমর্থ হয় সে। প্রত্যক্ষদর্শীকে উদ্ধৃত করে সে দেশের সংবাদমাধ্যম নিউ জিল্যান্ড হেরাল্ড খবর দিয়েছে, একজন তরুণ তার অসীম সাহসী ভূমিকার মধ্য দিয়ে বহু মানুষের জীবন রক্ষা করেছেন। তিনি ওই মসজিদ দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত খাদেম। শুক্রবার (১৫ মার্চ) নিউ জিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ এলাকার দুইটি মসজিদে বন্দুকধারীর হামলা হয়। এদের একটি শহরের হাগলি পার্কমুখী সড়ক দীন অ্যাভিনিউতে অবস্থিত আল নূর মসজিদ। আরেকটি মসজিদ লিনউডে অবস্থিত। দেশটির পুলিশ কমিশনার মাইক বুশ জানিয়েছেন, নিহতের সংখ্যা পৌঁছেছে ৪৯ জনে। এদের মধ্যে আল নূর মসজিদেই নিহত হয়েছেন ৪১ জন। লিনউডে ৭ জন মুসল্লি ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আর হাসপাতালে মারা যান একজন।প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে খবরে বলা হয়, লিনউড মসজিদের খাদেম ওই তরুণ হামলাকারীর বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে নিহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারত। প্রত্যক্ষদর্শী সৈয়দ মাজহারউদ্দিন নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডকে বলেছেন, ওই সময় ৬০ থেকে ৭০ জন মুসল্লি মসজিদে ছিলেন। গুলি শুরু হলে আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করেন তারা। ‘আমি তখন লুকানোর জায়গা খুঁজছিলাম। ওই সময় দেখলাম এক লোক অস্ত্র নিয়ে মসজিদের দরজা দিয়ে ঢুকল।’ মাজহার জানান, সামরিক কায়দার ক্যামোফ্লাজড গিয়ার পরিহিত ওই হামলাকারী তখন নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছিলো। ‘দরজার কাছেই ছিলেন বয়স্ক কয়েকজন মানুষ। হামলাকারী তাদের দিকেও গুলি চালায়। ওই সময় মসজিদের তরুণ খাদেম সুযোগ বুঝে হামলাকারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তার হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নেন।‘ বলেন তিনি। মাজহারের দাবি, ওই খাদেম হামলাকারীকে ধরার চেষ্টাও করেন। তবে বাইরে থাকা একটি গাড়িতে চড়ে সে সটকে পড়ে। নিউ জিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ এলাকায় মসজিদে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বাড়তি সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে রাজধানীর কূটনৈতিক পাড়ায়ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। ক্রাইস্টচার্চের এই ঘটনার পর কোনও গোষ্ঠী বা ব্যক্তি যাতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে, সেজন্য সজাগ রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিউ জিল্যান্ডে মসজিদে মুসলিম বিদ্বেষী হামলার পর পাল্টা হামলার আশঙ্কায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরাও নিরাপত্তা ‘ঝুঁকি চিহ্নিত’ করে সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মোহাম্মদ সোহেল রানা বলেন, ‘ক্রাইস্টচার্চের ঘটনাটি আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। আমাদের কোনও নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। তারপরও ঘটনার পরপরই আমরা রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছি। রাজধানীর কূটনীতিক এলাকায় এমনিতেই কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে, সেখানেও বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে।’ প্রসঙ্গত, শুক্রবার (১৫ মার্চ) নিউ জিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে এক অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে ৪৯ জন ইসলাম ধর্মালম্বী নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে অন্তত তিন জন বাংলাদেশি বলে জানা গেছে। হামলায় ক্রাইস্টচার্চের আল নূর মসজিদে ৪১ জন এবং লিনউডের আরেকটি মসজিদে ৮ জন নিহত হন। এই উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী হামলার সময় আল নূর মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যরা। মসজিদে ঢোকার কিছুক্ষণ আগে ওই হামলার ঘটনাটি ঘটে। ফলে অল্পের জন্য জীবন রক্ষা পান বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। এদিকে, ঘটনার পর ব্রেনটন ট্যারান্ট নামে এক অস্ট্রেলিয়ান নাগরিককে সন্দেহভাজন হামলাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দু’বছর ধরে নেওয়া পরিকল্পনার বাস্তবায়নকারী এই বন্দুকধারী হামলার চালানোর আগে অনলাইনে একটি দীর্ঘ বার্তা দিয়েছে। এতে সে হামলার কারণ উল্লেখ করে। সে নিজেকে শ্বেতাঙ্গ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের অনুসরণকারী হিসেবে উল্লেখ করে। ওই বার্তায় মুসলিম বিদ্বেষী বিভিন্ন ধরনের কথাও লিখেছে সে। গণমধ্যমে ব্রেনটনের এই ভাষ্য আসার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নানা রকম প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে কেউ বিদেশি নাগরিকদের ওপর হামলা করে বসে কিনা, সেই আশঙ্কা থেকেই রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বাড়তি সতর্ক ব্যবস্থা নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোসহ ভিজিবল পুলিশিং, টহল, পেট্রোল ও তল্লাশি চৌকির সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদ বলেন, ‘ক্রাইস্টচার্চের হামলায় আইডোলজিক্যাল পয়েন্ট থেকে দুটো বিষয় দেখতে পাচ্ছিÍ আমরা বলছি, প্রবাসীদের প্রতি বিদ্বেষ ও ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। একটা মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে, এই ইসলাম বিদ্বেষের কারণে আমরা যেন অন্য ধর্মালম্বীদের প্রতি বিদ্বেষী না হয়ে যাই, সেজন্য সামাজিক সম্প্রীতির ওপর আমাদের জোর দিতে হবে। একটি সহনশীল সমাজ গঠনের জন্যই এখানে কোনও ছাড় দেওয়া যাবে না। সমাজকে সহনশীল ও সহিষ্ণু রাখতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এমনিতেই আমাদের এখানে টেরোরিজম বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হয়। ফলে সেরকম কোনও আশঙ্কা নেই। তারপরও আমাদের এখানে তো কনস্ট্যান্ট একটা থ্রেট আছেই। জঙ্গিবাদের ঝুঁকির মধ্যেই আমরা আছি। এই বিষয়টাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বকে অস্থিতিশীল করার জন্য কেউ কেউ কাজ করতে পারে। শুধু জঙ্গি গোষ্ঠী না, জঙ্গি গোষ্ঠীকে বিভিন্ন জিও-পলিটিক্যাল কারণে অনেকেই তাদের মদদ দিয়ে থাকে, তাদের স্বার্থের জন্য। সেই ঝুঁকি থেকে তো আমার মুক্ত না। তো সেই ঝুঁকি চিহ্নিত করা, তার আঁচ কোথায় লাগবে, কিভাবে লাগবে, সেটি নির্ণয় করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই ঝুঁকি চিহ্নিত করে তা মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে হবে।’
আরেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমি মনে করি না এই হামলার পর বাংলাদেশে ভীষণভাবে এর কোনও প্রভাব পড়বে। কারণ, এই হামলা যে দেশে হয়েছে, তারা মোটামুটি অ্যাকশন নিয়েছে। তারপরও যেহেতু এখানেও এক ধরনের জঙ্গি বলি বা এক্সট্রিমিস্ট বলি, কিছু লোকজন তাদের আছে, আমাদের সিকিউরিটি সিস্টেম বা ইন্টেলিজেন্সে যারা আছেন, তাদের আরও সতর্ক থাকা উচিত। বিশেষ করে এক্সিট পয়েন্ট বা এন্ট্রি পয়েন্টসহ সব জায়গায় এলার্ট থাকতে হবে।’ সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের এখানে এমনিতেই এলার্ট আছে। আমি মনে করি না এখানে বড় ধরনের কোনও রিপারকেশন হবে। তবে আমাদের এলার্ট থাকা উচিত।’
Leave a Reply