সংগ্রাম ও প্রতিবাদ আর আত্মত্যাগ। এ ভাবেই পৃথিবীতে শ্রমজীবি মানুষ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। আদায় করেছে অধিকার। মানুষের কোন অধিকার সাধারণভাবে অর্জিত হয়েছে, এমন নজির পৃথিবীতে বিরল। আর এ সংগ্রাম একদিনের আকর্ষিক কোন বিষয় ছিল না। ছিল মানুষের পুঞ্জিভুত তীল তীল ক্ষোভের সম্মিলিত বহিপ্রকাশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার সুত্রপাত একক থেকে শুরু হয়ে লক্ষতে পৌঁছেছে। বেশীর ভাগের ক্ষেত্রে প্রথম বিদ্রোহী একককে জীবন দিয়ে অন্যদের বুঝাতে হয়েছে, শ্রমজীবিদের স্বাধীনতা নেই, মর্যাদা নেই, বেঁচে থাকার অধিকার নেই। আর একক রক্ত ত্যাগ, রক্ত বীজ হয়ে সমাজ অভ্যন্তরে, রাস্ট্র অভ্যন্তরে বৃহৎ মহির জন্ম দিয়েছে।
১৮৫৭ সালে ৮ মার্চ সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা কাজের ঘন্টা কমানো, কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তাপূর্ণ মজুরীর দাবীতে রাস্তায় মিছিল করে। এ মিছিলে পুলিশ বাধা দেয় ও গুলি করে। ফলে নারীর রক্তে রাজপথ ভিজে যায়। মার্কিন রাস্ট্রের নিউওয়ার্ক শহরে রাস্তায় নারীদের এ মিছিল ও আত্মত্যাগের ঘটনাটি ঘটে। আসলে এ দিন কি প্রথম নারী শ্রমিকরা নির্যাতিত হয়েছিল ? না, সেটি নয়। অর্থাৎ কারাখানা শুরু থেকে কম মজুরি দেওয়া আর বেশী সময়ে কাজ করিয়ে ঘটনা শুরু হয়। শ্রমিকদের সংগঠিতভাবে প্রতিবাদ করার বাস্তবতা না থাকায় একক প্রতিবাদ আর নিগৃত হতে হতে এক সময় রাজপথে নামে নারী শ্রমিকরা।
উনবিংশ শতাব্দির শুরুর সময়কাল। শ্রমিকরা তখন গড়ে ১২ ঘন্টার অধিক সময় ধরে কাজ করতে বাধ্য হতেন। বিনিময়ে যে মজুরী প্রদান করা হতো তা খুবই নগন্য। মালিকরা পুরা লাভটি নিয়ে নিত। শ্রমিকদের জীবনযাবন ছিল মানবেতর। উপরন্ত ছিল মালিকদের সীমাহীন নির্যাতন। কখনো কখনো তার রুপ ছিল ক্রীতদাসসম।
১৮৫৭ সালের ৮ মার্চের আন্দোলন তখনকার শাসকগোষ্টি ও মালিকপক্ষ পুলিশ আর প্রশাসনকে দিয়ে সাময়িক ভাবে নির্মম নির্যাতনের স্ট্রীম রোলারের চাকায় পিষ্ট করতে পারলেও যে রক্তবীজের জন্ম হয়, তা পরবর্তিতে পৃথিবীব্যপি ছড়িয়ে পড়ে। অর্জিত হয় দাবী সমুহ।
১৮৬০ সালে ৮ মার্চ নিউওয়ার্কের সুতা কারখানার শ্রমিকরা ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ স্মরণে প্রথম শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলে। এ ভাবেই সুতা কারখারার নারী শ্রমিকের রক্ত দানের ঘটনার মধ্যদিয়ে শ্রমিক আন্দোলন দানা বাধতে শুরু করে। এক সময় এ আন্দোলন কারখানার গন্ডি পেরিয়ে, দেশ পেরিয়ে আর্ন্তজাতিক মহলে ঝড় তোলে। এ সময় পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রের আন্দোলন গড়ে উঠা শুরু হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশে কমিউনিস্ট পাটির জন্ম হয়েছে। জার্মান কমিউনিস্ট পাটির নেত্রী ক্লারা জেটকিনের উদ্যোগে প্রথম আর্ন্তজাতিক নারী সম্মেলন জার্মানীতে অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে নারী শ্রমিকদের নায্য মুজুরী, কর্মঘণ্টা ও ভোটধিকারের দাবী উত্থাপন করা হয়। ১৯১০ সালে ২য় আর্ন্তজাতিক নারী সম্মেলন ডেনমার্কেও কোপেনহেগেন এ অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে ৮ মার্চকে আর্ন্তজাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর পর থেকে পৃথিবীর কমিউনিস্ট পাটি সমুহ স্ব স্ব দেশে ৮ মার্চ আর্ন্তজাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করে আসতে থাকে। রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর থেকে সামাজতান্ত্রিক দেশ গুলো বেশ গুরত্ব দিয়ে দিবসটি পালন করা শুরু করে।
সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের প্রভাবে ১৯৭৫ সাল থেকে জাতিসংঘ দিবসটি পালন করা শুরু করে। তবে জাতীসংঘের সাধারন পরিষদে দিবসটি পালনের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন লাভ করে ১৯৭৭ সালের ১৬ ডিশেম্বর। এ সময় জাতীসংঘ সদস্য দেশ সমুহকে দিবসটি তাৎপর্য তুলে ধরে পালনের অনুরোধ করে। ফলে অধিকার বঞ্চিত নারী সমাজের রাজনৈতিক, অর্তনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির পথ সগম হয়। আর্ন্তজাতিক ভাবে নারীর অধিকার মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানে নারী পুরুষের সমমর্যাদার কথা বলা আছে। কেবলমাত্র নারী হওয়ার কারনে কেউ যাতে বৈষম্যের শিকার না হয় তার সুরক্ষা আইনে দেওয়া হয়েছে। নারী নিরাপত্তায় বিশেষ বিশেষ আইন প্রনয়ন হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান শিল্প পোশাক শিল্প, যার অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, কর্মঘণ্টা এবং ন্যায্য মজুরী পাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ গুরুত্বের সাথে দেখে থাকে। যে নারী শ্রমিকদের মধ্য থেকেই দিবসটির উৎপত্তি হয়েছিল, বাংলাদেশে বর্তমানে সেরূপ নারী শ্রমিক রয়েছে কয়েক লক্ষ। নিউ ইউয়র্কের সেদিনকার সূচ কারখানার নারী শ্রমিক ও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার নারী শ্রমিক যেন একই সুত্রে গাঁথা। সময় ঘন্টা, মজুরী আর কাজের পরিবেশ নিয়ে আন্দোলন এখনও করতে হয়, রাজপথে রক্ত দিতে হয়। বাংলাদেশ প্রতি বছর যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে থাকে। কিন্তু এখানকার নারী পোশাক শ্রমিকেরা কতটা সুরক্ষিত তার প্রশ্ন থেকেই যায়। বাংলাদেশে নারীদের জন্য অনেক আইন ও বিধি বিধান থাকলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এখনও নারীরা উপেক্ষিত। নারীদের গৃহস্থালী কাজের অর্থনৈতিক স্বীকৃতি নেই। তালিকাভুক্ত নয় এমন শিল্প কারখানার নারী শ্রমিকেরা পর্যাপ্ত সুরক্ষা পায় না। তাদের ন্যায্য মজুরীর অভাব, মাতৃত্বকালীন ছুটির অভাব, নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি লক্ষ্যণীয়। জাতীসংঘের সদস্য রাস্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে দিবসটি সরকারী ব্যবস্থাপনায় বর্নাঢ্য ভাবে পালিত হওয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে নারী দিবসের আবেদন ও মূল্যবোধ এ সকল অনুষ্ঠানগুলোতে পাওয়া যায় না। বিষয়টা হচ্ছে বৈষম্যে কারণ যে বৈষম্যযুক্ত রাস্ট্র কাঠামো, তা পূর্বের অবস্থায় বিদ্যমান রেখে নারীর প্রতি বৈষম্য বন্ধ করা সম্ভব নয়। আবার এই বৈষম্যময় রাস্ট্র কাঠামো টিকিয়ে রেখেছে বর্তমান আমলাতন্ত্র ও আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাস্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা সকল গণ আন্দোলন, নায্য আন্দোলন এ পেটোয়া বাহিনী কতৃক নিয়ন্ত্রন করে থাকে শাসক মহল। তা সে শাসক যে দলের হোক না কেন ?
আসলে বৈষম্যময় রাস্ট্র কাঠামো টিকিয়ে রেখে, বর্তমান আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্য থেকে নারীর সামগ্রিক মুক্তি আনা সম্ভব নয়। প্রয়োজন মনন জগতের পরিবর্তন। মানুষ হিসেবে দেখার মানুষিকতা। যা মুনাফা ভিত্তিক সমাজে বহুলাংশে কাঠালের আমসত্ত্ব।
নারীর সামগ্রিক মুক্তি নিহিত আছে পুরুষতান্ত্রিক শোষন মুলক বর্তমান রাস্ট্র কাঠামোর পরিবর্তনের মধ্যে। সে জন্য প্রয়োজন সাম্যের নৈতিক মুল্যবোধ ধারনকৃত রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্বে নিরবিচ্ছিন্ন লড়াইয়ের মাধ্যমে বর্তমান রাস্ট্র কাঠামো ভেঙ্গে মানবিক, বৈষম্যহীন রাস্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা। সকল মানুষের মৌল অধিকারের স্বীকৃতি প্রদানের। জাতী, গোত্র, বর্ন ও লিঙ্গ ভেদের বৈষম্যের অবসান ঘটানো।
Leave a Reply