যদি কখনো কোনো আলোচনায় আপনাকে ডাকে কমল কুমার মজুমদারের বিষয়ে কিছু বলার জন্যে, তখন কী করবেন ? প্রথম দিকে বলতে দিলে হালকা একটু কেশে ভূমিকা করবেন। যদি পরের দিকে বলতে বলে তখনও একটু কেশে সামনে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাঁকিয়ে, তাদের মনোভাব বুঝে বলবেন, ‘শুভেচ্ছা, সবাইকে। ভূমিকা ছাড়াই শুরু করছি, কেননা কিছু ইম্পটেন্ট কথা বলবো বলে স্থির করেছি, যদিও সময়ের অভাব। তাই অল্প সময় নিয়ে কথাগুলো শেষ করে দিচ্ছি। আসলে কমলকুমার মজুমদার ছিলেন ‘কাল্টফিগার’। ‘…লেখালেখির প্রথম পর্বের কয়েকটি লেখার কথা না ধরলে, বলা যায়, কমলকুমার মজুমদার ১৯৫৭-৫৮ সাল থেকে নিয়মিত লেখা শুরু করেন। বিখ্যাত গল্প ‘তাহাদের কথা’ বা ‘মতিলাল পাদরী’ লিখে ঐ পর্ব শুরু। অবশেষে ১৯৫৯ সালে লেখেন তাঁর নজর কাড়া ধ্রুপদী উপন্যাস ‘অন্তর্জলী যাত্রা’Ñ খ্যাতি ও নিন্দা সমান্তরালভাবে এসময় থেকেই তাঁর দিকে প্রবলভাবে আসতে থাকে। তিনি হ’য়ে ওঠেন সবচেয়ে বিতর্কিত এবং অন্যদ্বীপের একাকী লেখক। তিনি নিন্দা-স্তুতিকে সমানভাবে গ্রহণ করে বাকী জীবনটুকু স্বল্প হ’লেও মূলত লেখাতেই নিজেকে সমর্পিত করেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে তাঁর লেখালেখির জীবন মোটামুটি কুড়িটি বছর। ‘মূলত’ বলতে হচ্ছে একারণে, যে, এসময়েতেও লেখালেখির পাশাপাশি নাটক প্রযোজনা করেছেন, ছবি এঁকেছেন, উড্কাট্-এ ব্যস্ত রেখেছেন নিজেকে, বই-এর অলংকরণ বা প্রচ্ছদও করেছেন। অবশ্য এসব ছাড়াও তাঁর অন্যান্য কার্যকলাপগুলি যেমন চলচ্চিত্র নির্মাণ, ডকুমেন্টরীর চিত্রনাট্য প্রস্তুত, শিল্পসমালোচক রূপে বিখ্যাত সাপ্তাহিকে যুক্ত হওয়া, ছবি-ছড়ার বই সংকলন ও সম্পাদনা এসব বিচিত্র কিন্তু সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে অনেক আগেই তিনি অর্জন করেছেন ‘কাল্টফিগার’-এর শিরোপা। ’ একটু থেমে সামনের দু’একজনের দিকে তাঁকিয়ে আবার বলবেন, ‘ভাবলে অবাক হ’তে হয় পুরোপুরি নাগরিক জীবন যাপন করে এই লেখক তাঁর সাহিত্যে বরাবর প্রান্তিক মানুষের কথা, তাদের জীবনের আলেখ্য শুনিয়েছেন তাঁর স্বল্পসংখ্যক পাঠককে নবতম ভাষায়, নতুনতম আখ্যানরীতিতে গড়পড়তা পাঠককুলকে ক্রমাগত অগ্রাহ্য করে, বাণিজ্যিক সাহিত্যের গড্ডালিকায় আদৌ গা না ভাসিয়ে। কিছুটা বেপরোয়া হয়েও। ’১
এবার একটুখানি থেমে যাবেন আর ভাবখানা এমন করবেন একদমে অনেক বলেছি। একটু শ্বাস নিয়ে আবার যথারীতি চন্দ্রবিন্দু যোগ করে একটু ভাব এনে বলতে থাকবেন ‘…এঁর বই গোয়েন্দা লাগিয়ে সংগ্রহ করতে হয়। অনেক সাহিত্যের বড় গবেষকও এঁর নাম শোনেননি। … সদ্য তরুণ কবি ও লেখকেরা এঁর অন্ধ-ভক্ত। ইনি ইংরেজের অধীনে স্কুল-কলেজে পড়তে অস্বীকার করেছিলেন। ইংরেজি ভাষা না লিখে লিখেছেন সংস্কৃত ও ফরাসী। ইনি ইচ্ছে করে এমনই এক দূর্বোধ্য ভাষায় এঁর কাহিনীগুলি লেখেন যে সাধারণ পাঠকের পক্ষে তাতে দাঁত ফোটানো অসম্ভব। দূর্বোধ্যতায় ইনি জেমস জয়েসকেও ছাড়িয়ে গেছেন। কিন্তু যতœ করে যারা এঁর রচনা কিছুটাও পড়েছে তারাও স্তম্ভিত হয়ে স্বীকার করেছে যে এরকম রসবোধ ও বৈদগ্ধ্যের সম্মিলন খুব কমই দেখা যায় যে-কোনো সাহিত্যে। কিন্তু কমলকুমার মজুমদার চান না তাঁর লেখা দুশো তিনশো জনের বেশি পাঠক পড়ুক ! এরকম অদ্ভুত লেখক আর কোথাও আছে কিনা জানি না। ’২
এ পর্যন্ত বলে একটু তাকিয়ে বুঝে নেবেন সামনের মানব-মানবীরা বিরক্ত কী না। বিরক্ত না হলেও আর এগোবেন না। বলবেন, সবশেষে আমি কমল মজুমদারের নিয়ে একটা কৌতুক, না ঠিক তাঁর কৌতুক নয় তাঁরই ঘটানো একটা মজার ঘটনা বলে শেষ করবো। বোন শানু লাহিড়ী লিখেছেন, “… একদিন বাস থেকে নেমে কী হাসি ! বাড়ির সামনেই বাস থামতÑ দাদা নামার সময় বলছে, ‘আস্তে আস্তে, একদম আস্তে, লেডিস হ্যায়। ’ দাদা নামার সঙ্গে সঙ্গে কন্ডাক্টর জিজ্ঞেস করল কই আপনার লেডিস ? দাদা বুকে হাত দিয়ে বলল, দিল মে। কন্ডাক্টর খুব হেসেছে, দাদাতো বটেই। ” কমল মজুমদারের নিজের ভাবনা ছিল এমন, ‘পৃথিবীতে আমার কেউ ছিল না বললে ভুল করা হবে, বলব, আমি কারোর ছিলাম না। ’
‘আকাশ ভোলা পাখির কি কেউ থাকে ! তার গান কি সবাই বোঝে !’ আমিও কি কিছু পেরেছি বোঝাতে ? অনেক বেশি ভালো থাকবেন সবাই।
পাদটিকা : সুন্দর বক্তব্যের পর যখন বেরিয়ে এলেন বাইরে ঠিক সে সময় সুন্দর ছেলেটা জানতে চাচ্ছে ‘বলার সময় আপনি যে কাল্টফিগার বলেছিলেন ওটা কী Cult হবে, সেটার মানে কী ? কী বিপদ! বলবেন, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী স্যারের সম্পাদিত ফিফ্ট রিপ্রিন্ট জানুয়ারি দুই হাজার বারো’র-Bangla Academy English-Bangla Dictionary’র ১৮২ পাতাটা দেখলে বিস্তারিত পাবে।
১. সম্পাদকের কথা: প্রতিবিম্ব : কমলকুমার মজুমদার শতবর্ষ স্মরণ সংখ্যা, দ্বিতীয় পর্যায়, বৈশাখ ১৮২১, সম্পাদনা: প্রশান্ত মাজী, কলকাতা। পাতা: ৫।
২. শহর কেন্দ্রিক: সাহিত্যের কোনও শর্ত নেই: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দে’জ, কলকাতা: এপ্রিল ২০১১। পাতা: ১০৩।
Leave a Reply