২০১৩ সাল থেকে নিকোলাস মাদুরো ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাবা ছিলেন শ্রমিক নেতা। পারিবারিকভাবেই মানুষটির রাজনীতিতে হাতেখড়ি। পড়াশোনায় খুব বেশি এগোতে পারেননি। জীবিকার তাগিদে ড্রাইভারের কাজ করেছেন। রাজনীতির কারণে খেটেছেন জেলও। পরবর্তীতে সেই মানুষটি হন ভেনেজুয়েলার ৬৫তম প্রেসিডেন্ট। নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে তিনি আজ রাষ্ট্রের অধিপতি।
প্রবাদ আছে ‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়’। ইচ্ছাশক্তি মানুষকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যায়। তবে শুধু ইচ্ছা থাকলে এগিয়ে যাওয়া যায় না। ইচ্ছা পূরণের জন্য থাকতে হয় আত্মবিশ্বাস এবং ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করতে হয়। তেমনি হয়তো তুমুল ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে হয়ে উঠেছেন বাসচালক থেকে প্রেসিডেন্ট। তিনি নিকোলাস মাদুরো।
১৯৬২ সালে নিকোলাস মাদুরো ভেনেজুয়েলার কারাকাসে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারে তার তিন বোন এবং তিনি একমাত্র ভাই। তার বাবার নাম গার্সিয়া। ১৯৮৯ সালে মোটর গাড়ি দুর্ঘটনায় তার বাবা মারা যান। বাবা শ্রমিক নেতা ছিলেন। পাশাপাশি বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল। সেই সুবাদে তার পরিবারে চলত রাজনীতি চর্চা। পড়াশোনা তেমন করতে পারেননি। কর্মজীবী সন্তানদের এল ভ্যাল রাজ্যের লিসিও জোস আভালোসের সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। রাজনীতির সঙ্গে প্রথম যুক্ত হন ঐ বিদ্যালয়ের ছাত্র সংঘের সদস্য হওয়ার মাধ্যমে। তার রাজনীতি হাতেখড়িটা হয়েছিল পারিবারিকভাবেই।
জীবন চলার তাগিদে তিনি জীবিকা শুরু করেন বাসচালক হিসেবে। আন্ডার গ্র্যাজুয়েট মাদুরো জীবিকার তাগিদে বেশ কয়েক বছর কারাকাস মেট্রো সিস্টেমে বাস ড্রাইভারের চাকরি করেন। ভাবতেই অবাক লাগে যে, বাস চালক থেকে প্রেসিডেন্ট। এটা কোনো রূপকথার গল্প নয়। এটা একটা স্বপ্ন পূরণের গল্প। রাজনীতির ফাস্ট ইস্যু শুরু হয় ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে। তুমুল ভাবেই শুরু করেন আন্দোলন। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নেমে পড়েন রাজপথে। এক পর্যায়ে কোম্পানি ট্রেড ইউনিয়ন বন্ধ করে দেয়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হোসে ভিনসেন্তে র্যাঞ্জেলের দেহরক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তবে মাদুরো মূলধারার রাজনীতিতে আসেন ১৯৯০ সালে। হুগো শ্যাভেজের সামরিক আন্দোলনে যোগ দিয়ে। সেই আন্দোলনের বেসামরিক শাখা এমবিআর-২০০’র সদস্য হন মাদুরো।
১৯৯২ সালে সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনায় শ্যাভেজের কারাদ- হয়। ১৯৯৪ সাল, শ্যাভেজ কারাবন্দী। দেশের অস্থির অবস্থা। আর এই অস্থির অবস্থার মুক্তির উপায় দেখতে পান শ্যাভেজের মুক্তি। শ্যাভেজকে তিনি পিতার মতো শ্রদ্ধা করতেন। তার কারাবন্দী কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। শ্যাভেজের মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হন। তুমুল আলোচিত হয়ে লাইমলাইটে আসেন নিকোলাস মাদুরো। সৌভাগ্যক্রমে ওই বছর মুক্তি পান শ্যাভেজ এবং ১৯৯৮ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসেন তিনি।
তখনকার সময় প্রথমবারের মতো ভেনেজুয়েলার ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্য হন মাদুরো। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালে তিনি ভেনেজুয়েলার সংবিধান প্রণেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ডেপুটি হিসেবে দায়িত্ব পান। ২০০০ সালে আইন বিভাগের প্রধান হিসেবে মনোনীত হন মাদুরো। ২০০৬ সালে ভেনেজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নির্বাচিত হন মাদুরো। আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদের কড়া সমালোচক ছিলেন হুগো শ্যাভেজ। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুশকে ‘খুনি’ এবং ‘রক্ত পিপাসু’ বলে অভিহিত করেছিলেন শ্যাভেজ। সেই একই আদর্শ এবং মানসিকতার অনুসারী নিকোলাস মাদুরো।
২০০৭ সালে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তৎকালীন আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিসা রাইসকে ‘হিটলার’ এবং ‘ভ-’ বলে উল্লেখ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মাদুরো নিজের মুনশিয়ানার পরিচয় দেন প্রতিবেশী দেশ কলম্বিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে। এ ছাড়াও তারই সময়ে ইরান এবং অন্য কমিউনিস্ট শাসিত দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হয়। ২০১২ সালে হুগো শ্যাভেজ পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার পর ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান মাদুরো। ক্যান্সার আক্রান্ত শ্যাভেজের স্বাস্থ্যের সর্বশেষ অবস্থা গণমাধ্যমে মাদুরোই প্রকাশ করতেন। শ্যাভেজের কাছে মাদুরো ছিলেন সন্তানতুল্য।
৫ মার্চ, ২০১৩ তারিখে শ্যাভেজ মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর নিকোলাস মাদুরো ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন এবং রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিজে নেন। তার এই দায়িত্বকে ভেনেজুয়েলার সংবিধান অমান্য এবং ভঙ্গ করার অভিযোগ তোলেন বিরোধীদলীয় নেতারা। বিরোধীদলীয় নেতাদের মতে শ্যাভেজের মৃত্যুর ফলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় আরোহণের মাধ্যমে তিনি ভেনেজুয়েলার সংবিধানের ২২৯, ২৩১ ও ২৩৩ নং ধারা ভঙ্গ করেছেন। ২০১৩ সালের ১৪ এপ্রিল তারিখে অনুষ্ঠিত বিশেষ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি নতুন রাষ্ট্রপতিরূপে অত্যন্ত স্বল্প ১.৫% ভোটের ব্যবধানে সরাসরি নির্বাচিত হন। নির্বাচনে তিনি ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টির পক্ষাবলম্বন করে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হন। তার প্রধান ও একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মিরান্ডার গভর্নর হেনরিক ক্যাপ্রিলস। মাদুরোর স্ত্রী সিলিয়া ফ্লোরেস ভেনেজুয়েলার ন্যাশনাল কংগ্রেসের স্পিকার এবং একজন আইনজীবী।
Leave a Reply