দক্ষিণ পশ্চিম উপকুলীয় অঞ্চলের ঐতিহাসিক নদী যমুনা। যমুনা নদী সম্পর্কে সতীশ চন্দ্র মিত্র তাঁর যশোর খুলনার ইতিহাস গ্রন্থে বলেন:
‘এ যমুনা সেই যমুনা
যে যমুনার তটে ইন্দ্রপুরী তুল্য রাজপাট বসাইয়া কুরুপান্ডবে ইন্দ্রপ্রস্থ
হস্তিনাপুরে রাঙ্গামেুয় যজ্ঞ সুসম্পন্ন করিয়া ছিলেন,
যে কালিন্দী তটে বংশীবটে শ্রীকৃষ্ণের প্রেমধর্মের অপূর্ব লীলাভিনয় হইয়া ছিল,
যে যমুনা তীরে দিল্লী-আগ্রায়-মথুরা-প্রয়াগে হিন্দু-মুসলমান
বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান মোঘল-ইংরেজ
শতশত রাজ-রাজেশ্বর সমগ্র ভারতের
রাজদভ পরিচালনা করিতেন
এ সেই একই যমুনা।
সেই তমালকদম্ব পরিশোভিত কোকিল কুজন মুখরিত
নির্ম্মল সলিলে প্রবাহিত
ভটশালিনী সুন্দর যমুনা।’
যমুনা নদীকে কেন্দ্র করে ছিল ঐতিহাসিক ও প্রত্মাত্বিক স্থাপত্য নিদর্শন, ধর্মীয় এবং লোকজ উৎসব ও সংস্কৃতি। এ ক্ষেত্রে যমুনা নদীর চতুর্থ খ-ের বিষয়টা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে চাই। যমুনা নদীর চতুর্থ খন্ডর মধ্যে রয়েছে অসংখ্য সংযোগ খাল, যা এক সময় স্থানীয় মৎস্য বৈচিত্র্যের আধার ছিল। খালগুলোর মধ্যে অন্যতম-ইছামতি, কদমতলী, সীমানা খাল, সোনার মোড় থেকে শরৎখানা খাল, বংশীপুর থেকে মাহমুদপুর সীমানা খাল, সোনার মোড় শ্মাশনঘাট দিয়ে সরদার বাড়ীর পশ্চিম দিক হয়ে হানারখালীর উপর দিয়ে কদমতলী সীমানা খাল, শরতখানা থেকে ভৈরব আলীর বাড়ীর দক্ষিণ দিক দিয়ে, বংশীপুর বীদগাহ সীমানা হয়ে গজলমারী, কদমতলী সীমানা খাল ও হাফরখালী শিশেল খাল ইত্যাদি।
এ খানে অসংখ্যা বিল আছে। যেমন: নলবিল, হাফরবিল, দিঘীর বিল, কাশিপুরবিল, পশ্চিমবিল, হানরখালী বিল, মৃতঘেরী বিল, কাঁদার বিল, মাহমুদপুর চর, ফুলবাড়ির চরের বিল, চরের বিল, আঠারখানার হুলোর বিল ইত্যাদি।
যমুনা নদীর চতুর্থ খ- ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান। কাকশিয়ালী থেকে মাদার নদী পর্যন্ত যমুনা নদীর সর্বমোট ৫টি খন্ডর মধ্যে চতুর্থ খন্ডই প্রত্মাতাত্বিক নির্দশনের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত। এক সময় প্রবাহমান যমুনা নদীর চতুর্থ খ-ের দুই তীরে ছিল অনেক ঐতিহাসিক স্থাপত্য। যার মধ্যে বুরুজপোতা, বংশীপুর শাহী মসজিদ, যশোরেশ্বরী কালিমন্দির, হাম্মাম খান, শরৎবালা পুকুর, ত্রিকণা শিবমন্দির, খৃষ্টান গীর্জা, ধুমঘাট রাজধানী, জমিদারবাড়ীর চাউল ধোঁয়া পুকুর, শরতবালা স্মৃতিস্তম্ভ, জমিদার গোলাবাড়ী, শাহী মসজিদ গোরস্থান ও ঈদগাহ, সোনার মোড় শ্মশান ঘাট ইত্যাদি।
ইতিমধ্যে ঐ সমস্ত ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন গুলোর অধিকাংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যমুনা নদীর চতুর্থ খ-ের বন্দোবস্ত বা ইজারা বাতিল করে প্রবাহ সুষ্ঠ করলে রক্ষা পাবে বিলুপ্ত প্রায় স্থাপত্য নিদর্শনগলো। অন্যথায় ইতিহাসের পাতা থেকে চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে ইতিহাস প্রদিদ্ধ ঐ সমস্ত প্রত্মতাত্বিক স্থাপত্য নির্দশন সমূহ।
যমুনা নদীর চতুর্থ খ-ে হিন্দু ধর্মালম্বীদের কাছে অত্যান্ত পবিত্র স্থান। দেবরাজ ইন্দ্রের সহধর্মীনীর নাম বারুনী দেবী। মধুকৃষ্ণ ত্রয়োদশী তিথিতে মর্তে আগামন করেন ভক্তদের সাক্ষাতের জন্য। দেবীর আগমন উপলক্ষে উক্ত তিথিতে ভক্তবৃন্দ সমবেত হয়ে যমুনা নদীতে ¯œান করেন। তাদের ধারনা এই শুভদিনে বারুনী ¯œানমঙ্গল বয়ে আনবে। সেই আবহমান কালের ঐতিহ্য আজও হিন্দু ধর্মালম্বীরা পালন করে আসছে।
নদী শুকিয়ে গেলে সভ্যতা বাঁচেনা। দখল ও দূষণ, নদী ও জলাশয়ের দুশমন। নদীর জীবনের সাথে কৃষি, পরিবেশ, প্রতিবেশ, জীবন-জীবিকা, স্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব জড়িত। শ্যামনরের ঐতিহাসিক যমুনা নদীর জীবন ও স্কৃতি আজ ধবংস ও ক্ষত-বিক্ষত।
কাকশিয়ালী থেকে মাদারনদী পর্যন্ত প্রবাহমান যমুনা নদীর সাথে সংযোগ ছিল ৪০টি খাল, ৪৪টি বিল, ৫৪টি স্থাপত্য নিদর্শন, ২৪ প্রকার লোকজ ও ধর্মীয় উৎসব। যমুনা নদী দখলের পূর্বে এ অঞ্চল ছিল স্থানীয় কৃষি প্রানবৈচিত্র্য, গবাদিপশুবৈচিত্র্য, মৎস্যবৈচিত্র্য, উদ্ভিদবৈচিত্র্য ও অসংখ্যা জলজপ্রালবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ। ভূমি, নদী ও জলাশয় দুশমনদের ভোগ বিলাসীতার জন্য চিরতরে ধবংস ও বিলুপ্ত প্রায়া। নদী ভোগ দখলের অধিকার কখনও একজন ব্যক্তির হতে পারে না। তাহলেই নদী বিপন্ন হয়ে পড়ে, যেমনটি হয়েছে যমুনা নদী উপর সকলের অধিকার প্রতিষ্টা হবে, নদী বিপন্ন হয় না, নদী হয় প্রবাহমান ও জীবন্ত।
Leave a Reply