ভাবনার অভিব্যক্তিকে শিল্পিত রূপে প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হলো কবিতা। যাতে মনের আলো আঁধারি ক্যানভাসে নান্দনিকতার আঁচড়ে জীবন কথনের ছবি আঁকা হয়। আর সে ছবিতে থাকে আস্বাদনের ব্যঞ্জনায় চির নতুনের এক অনিবার্য সন্নিবেশ। যা বুঝবার কোনো চূড়ান্ত পর্যায় থাকে না। বিজ্ঞান অঙ্ক বা অন্য কোনো বিষয় একবার বুঝে গেলে তার মধ্যে নতুন করে বুঝবার আর কিছু থাকে না। কিন্তু কবিতা বোদ্ধা পাঠক যতোবার পড়বেন বা গুণি আবৃত্তি শিল্পীর কন্ঠে যতোবার শুনবেন ততোবার বোধের সীমানা প্রসারিত হতে থাকবে। সেক্ষেত্রে কবিতা বুঝবার চূড়ান্ত কোনো পর্যায় থাকে না। কবিতা পড়লে বা আবৃত্তি শুনলে মনের মধ্যে যে অনুভূতির নীরব বা সরব উপস্থিতি টের পাওয়া যায় তাই হলো ওই কবিতার অর্থ। সেখানে একটা কবিতার অর্থ একেকজনের কাছে একেক রকমের হতে পারে। মূলত চেতনার অভিব্যক্তিকে নাড়া দিয়ে মনের ঘুমান্ত সত্তাকে জাগিয়ে তোলে কবিতা। দেহ ও মন নিয়ে যেমন পুরো একটি মানুষ, তেমনি কাব্যভাষাও কাব্য ভাবনা নিয়ে গোটা একটা কবিতা। কবিতা তৈরি হয় ভাব, ভাষা, ছন্দ অলঙ্কারের পারস্পারিক সম্পর্কের মধ্যদিয়ে; আর কবির তৃতীয় নেত্রের প্রসাদে ব্যঞ্জনায় ও ইঙ্গিতে ধীরে ধীরে কাব্যশরীরের সঞ্চারিত হয় মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণ যা শুধু কবির একার নয়। লক্ষ জনের প্রাণেও স্বোত্তরণের প্রেরণা জোগায়। কিন্তু কবিতার সেই মৃতুঞ্জয়ী প্রাণ, প্রতিষ্ঠায় কবির যে ধাপগুলো অতিক্রম করতে হয় তা নিতান্তাই এক আধ্যাত্মিক পথে হেঁটে পৌঁছাতে হয় সেই মহাশক্তির মুখোমুখি। তারপর যন্ত্রণা আর নিজের ভেতর উথাল পাথাল এক ভাবনা জ্বালাতে থাকে।
একজন কবি যখন কবিতা রচনা করেন তার অনেক আগে থেকে তাঁর ওপর ভর করে শৈল্পিক এক ভাব। আর সে ভাব কোথা থেকে আসে, কী ভাবে আসে সে প্রশ্নের মীমাংসা হয়তো কোনো দিনই হবে না। তবে একথা সত্য কবি কখনো ইচ্ছে করলেই কবিতা লিখতে পারেন না। তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় দিনের পর দিন রাতের পর রাত। সাধনা করতে হয় অনিন্দ্য এক সুন্দরের। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংগীতে তার স্পষ্ট প্রমাণ মেলে। তিনি লিখলেন, ‘বসে আছি হে কবে শুনিব তোমার বাণী/তুমি যাহা বলিবে তাই বলিব আমি কিছুই না জানি।’ ভাব না আসা পর্যন্ত তাঁর কিছুই করার থাকে না। ইচ্ছে করলেই লেখা যেতে পারে, তবে তা কতোটা কবিতা হয়ে ওঠে তা পাঠকই ভালো বুঝবেন। চলতে থাকে তার ভাবের একাগ্র সাধনা।
তারপর এক শুভক্ষণে যখন কুয়াশাছন্ন ধোঁয়াশার মধ্যদিয়ে সেই অলৌকিক ভাবের রশ্মি কবির মনমন্দিরে প্রবেশ করে। আর তখনি শুরু হয় কবির অন্তর্সত্তার অমীমাংসিত ব্যবচ্ছেদ। তখন ভাবকে বাণীতে রূপান্তরের জন্য তিনি পাগল হয়ে ওঠেন। সৃষ্টির তাড়নায় আত্মহারা হয়ে যান। নিজেকে ভাব আর বাণীর সেতুতে বাঁধতে মরিয়া। পৃথিবীর আর কোনো ভাবনা স্পর্শ করতে পারে না তখন কবিকে। পুড়তে থাকেন অলৌকিক এক সৌন্দার্যের আগুনে। আর সে যন্ত্রণা ঘণিভূত হতে থাকে বোঝা না বোঝার আলো আঁধারি ক্যানভাসে। নিজেকে হারিয়ে কবিমন মুহূর্তে ঈশ্বর হয়ে, ভাঙাগড়ার খেলায় মেতে ওঠেন। বারবার নিজেকে ভেঙে গড়তে থাকেন আপন মনে। কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারছেন না নিজের প্রতি। কী এক সুন্দর যেন তিনি দেখতে পাচ্ছেন, বুঝতে পারছেন অথচ ধরতে পারছেন না। এই না ধরতে পারার যন্ত্রণা তাকে সমাজ থেকে ছিটকে ফেলছে। সাধারণ দৃষ্টিতে তখন তিনি হয়তো পাগল। যে সুন্দরের আরাধনায় তিনি পাগল, যার রূপ নির্মাণে দিন নেই রাত নেই নাওয়া নেই খাওয়া নেই। তাকে ধরতেই হবে। সমস্ত পৃথিবী এমনকি তার বাইরেও কবিমন দৌড়াতে থাকে। তারপর এক সময় ধরা দেয় সেই কাক্সিক্ষত সুন্দর। ভাব রূপ পায় বাণীতে। রচিত হয় কবিতা। কবি মুক্তি পান সৃষ্টির যন্ত্রণা থেকে। হেসে ওঠে তাঁর নতুন পৃথিবী।
মনের নান্দনিক নির্যাস আর ঐশ্বরিক ভাবের মিলনক্ষেত্রে শিল্পের যে সুন্দর ধরা দেয়, তার অনিবার্য গাঁথুনি কবিকে মুক্তি দেয় সব অন্তর ব্যবচ্ছেদের অমীমাংসিত যাতনা থেকে। আর তখন সমুদ্র মন্থনের মতো নিজেকে আবিষ্কার করেন মহাজাগতিক এক পবিত্রতায়।
এখানেই শেষ নয়। চলতে থাকে অলঙ্করণের কাজ। নিজের শব্দভা-ার থেকে শব্দ সাজাতে চলে ভাঙাগড়ার আরেক খেলা। যতোক্ষণ না অনিবার্য শব্দের সন্নিবেশে সব চাইতে সুন্দরতম উপস্থাপন ধরা না দিচ্ছে ততোক্ষণ কবি নিজের প্রতি কোনোভাবেই সন্তুষ্টু নন। এক্ষেত্রে একটা কবিতার জন্য কবিকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস শ্রম দিতে হয়। সে শ্রম নির্মোহ এবং একান্তই শিল্পর জন্য দিয়ে থাকেন। তারপর আবার একদিন কবি নিজেকে আবিষ্কার করেন তাঁর পূর্ণ সৃষ্টির মধ্যে। সব থেকে বেরিয়ে এসে আবার মিশে যান সামাজিক মিছিলে। তখন তিনি নিজের লেখা কবিতা পড়ে অবিভূত হন। কী তাঁর সৃষ্টি। এযেন তাঁর পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিলো না। যতোবার পড়েন নিজের কবিতা ততোবারই আবিষ্কার করেন নতুন নতুন বিষয়। প্রসারিত হতে থাকে ভাবনার মহাজগৎ। এভাবেই সাধারণ মানুষ থেকে একজন কবি আলাদা।
ব্যাপারটা যদি ধর্মের সাথে বিচার করি তবে দেখবো কবি আর নবী দুজনের কাছে আসে ঐশ্বরিক শিল্প। নবীর কাছে আসে বাণী। যা হুবহু লিপিবদ্ধ করতে হয়। তার কোনো অংশ বা অংশবিশেষ কোনোভাবেই পরিবর্তন পরিমার্জন বা সংশোধনযোগ্য নয়। পক্ষান্তরে কবির কাছে আসে ভাব। আর সে ভাবকে বাণীতে রূপন্তরের দায়িত্ব কবির। ভাবকে বাণীতে রূপান্তর এবং তাতে অলঙ্করণের নেশা যখন কবিকে গ্রাস করে তখন তিনি শুধু ঐশ্বরিক ভাবের বাহন নন, নিজেও ঈশ্বর হয়ে ওঠেন। নবীর জগৎ সসীম, কবির জগৎ অসীম। নবী শুধু স্রষ্টার প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁর বাণী প্রচার করেন। আর কবি ভাবের রথের সারথী হয়ে চষে বেড়ান বিশ্বব্রহ্মা-। চাষ করেন অনাগত শিল্পের।
Leave a Reply