-অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী
পৃথিবীর বৃহৎত্তম নিরবচ্ছিন্ন ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। এ বনের পাদদেশে সৃষ্ট জনপদের ভূমির গঠন উপরের মিষ্টি পানি আর সাগরের লোনা পানির মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে। গঙ্গার প্রধান দু’ধারা ভাগিরথি ও পদ্মার সঙ্গম ঘটেছে এখানে এসে। এ এক অপূর্ব ভূমি। লোনা ও মিষ্টির সংমিশ্রণ এ মাটির প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ অঞ্চল গঠনে গঙ্গা-ভাগিরথি নদীর শাখাসমূহের অবদান প্রধান। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের মধ্যে অঞ্চলটির অবস্থান।
সারা বিশ্বজুড়ে অসীম কৌতুহল অনন্য এই অঞ্চলকে নিয়ে। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বলে ঘোষিত সুন্দরবন গোটা পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ জাতীয় গাছের বন যেখানে বাঘ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে এখনও টিকে আছে। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনযুক্ত বদ্বীপ সুন্দরবন গড়ে উঠেছিল গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদী দুটির মোহনায়। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেষে গড়ে উঠা অরণ্যময় ভূখন্ড সুন্দরবন নামে পরিচিত।
গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদী দুটি অজস্র শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। সৃষ্টি করেছে পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন গড়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগর ও বঙ্গোপসাগরে পতিত এ অঞ্চলের নদীসমূহের সঙ্গমস্থলে। নোনা জলে টিকে থাকতে পারে এমন গাছের বনকেই ম্যানগ্রোভ’ বা স্থানীয় ভাষায় বাদাবন’ বলা হয়। এই ধরনের বনের গাছগুলি ডাঙ্গায় জন্মালেও দিনের কিছুটা সময় এদের জোয়ারের নোনাজলে ডুবে থাকতে হয়। এই বিশেষ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে এই গাছগুলির মাটির ওপরে খানিকটা মাথা উঁচু করে থাকা বিশেষ ধরনের মূল বা শ্বাসমূল দেখা যায় যা দিয়ে গোড়া ডুবে থাকলেও মূলগুলি জলের ওপর থেকে শ্বাস নিতে পারে।
‘ভৌগলিক পরিবর্তন এ অঞ্চলকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। নদ-নদীর গতিধারা ও ভূমি-ভাগের হঠাৎ ব্যাপক পরিবর্তন কখনো কখনো জীববৈচিত্র্যের অনুকূলে এসেছে, জীবনযাপনের উপযোগী নানা পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। আবার কখনোবা ভৌগলিক পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রতিকূলতার প্রচন্ড প্রকোপে জনজীবন স্তিমিত হয়ে পড়েছে। সমৃদ্ধ জনপদ জলরাশিতে বিলীন হয়েছে।’ (সতীষ মিত্র, যশোর খুলনার ইতিহাস)
আর. জি. ওল্ডহ্যাম তাঁর Geology of India : Stratigraphical and Structural Geology (1893) (১৮৯৩) বইতে উল্লেখ করেছেন যে, ভূতত্ত্বানুসন্ধানকালে তিনি এই অঞ্চলের ভূগর্ভে যে পরিমাণ নুড়ি ও কাঁকুড়ে বালির সংস্তরের সন্ধান পেয়েছেন তাতে তিনি মনে করেন যে, সুদূর কোনও এক অতীতে এখানে ছোটো ছোটো পাহাড় ছিল যা ভূমি নিমজ্জনে বসে গেছে। এই কারণে বোধহয় এ অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠ অন্যান্য বদ্বীপের ন্যায় সমতল নয়। ভূতত্ত্ববিদগণ কোনও এক অজানা অতীতে এ অঞ্চলে একাধিকবার ভূমিকম্প বা অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণে ভূমি বসে বা নেমে যাওয়ার কথা বলেছেন। কারণ তাঁর মতে কোনও বদ্বীপ অঞ্চলের নিচে এ ধরনের পাথররাশি ও কাঁকড়বালি থাকে না। এর আরও প্রমাণ হিসেবে উলে¬খ করা যায় কলকাতার শিয়ালদহর কাছে পুকুর খুঁড়ে প্রায় তিরিশ ফুট নিচে সুঁদরীগাছের অনেক গুঁড়ি পাওয়া গিয়েছে। মাতলার কাছে দশ বারো ফুট মাটি খুঁড়ে একসময় দেখা গিয়েছে একাধিক সুঁদরীগাছ কঙ্কালের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এগুলি ভূস্তর নিমজ্জনের নিদর্শন। সেইজন্য সভ্যতা সংস্কৃতির কোনও কীর্তিচিহ্ন এখানে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
একটি মত অনুযায়ী প্রায় ৬-৭ হাজার বছর আগে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও তার অসংখ্য শাখা প্রশাখা দ্বারা হিমালয় ও ছোটনাগপুর পর্বতমালা থেকে বয়ে আনা নুড়ি, পলি, কাদা, মাটি বঙ্গোপসাগরের কাছে মোহনায় এসে ক্রমে গড়ে উঠেছে এই সুন্দরবন’ বদ্বীপ অঞ্চল (কুমুদ রঞ্জন নস্কর, পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন : প্রকৃতি ও পরিচিতি, পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা সংখ্যা, পৃ. ৪০৮-৯, সন ১৪০৬)। আরও সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুসারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপিকা ড. মঞ্জু ব্যানার্জির মতে পে¬স্টোসিন যুগ থেকে ফুলের রেণু পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে সুন্দরবনের যে বনভূমি সৃষ্টি হয়েছিল তার বয়স কম করেও ১৪ হাজার বছর। আর এখানে প্রাণী জগতের যে অস্তিত্ব আবিষ্কার হয়েছে তার বয়স কম করেও ১২ হাজার বছর। (প্রত্নতত্ত্বে সুন্দরবন : ড. মঞ্জু ব্যানার্জি, শ্রীখন্ড সুন্দরবন, সম্পাদক : দেবপ্রসাদ জানা)। এই তথ্য থেকে সাউথ সিটি কলেজের প্রত্নতত্ত্বের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. নির্মলেন্দু মুখোপাধ্যায় অনুমান করেন, বনভূমি ১৪ হাজার বছর আগে গঠিত হলে (সুন্দরবনের) ভূমি গঠিত হয়েছে আরও ৪-৬ হাজার বছর আগে, অর্থাৎ ১৮-২০ হাজার বছর আগে। আমরা একথা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এই তথ্য ঠিক হলে অনন্ত ১৪ হাজার বছরেরও আগে কোনও একসময় এখানকার ভূমি গঠিত হয়। সমুদ্রের মধ্যে ক্রমে গড়ে ওঠা ছোটো ছোটো টিলাগুলির চারধারে নদীবাহিত পলি জমে এই ভূমি গড়ে ওঠে বলে কেউ কেউ অনুমান করেছেন।
প্রাচীন সাহিত্যের মধ্যে সর্বপ্রথম রামায়ণে গঙ্গাসাগর সঙ্গমের উৎপত্তির কথা পাওয়া যায় (বাল কাণ্ড)। এরপর মহাভারতে অর্জুনের গঙ্গাসাগর সঙ্গমে তীর্থযাত্রায় আসার উলে¬খ পাওয়া যায় (বনপর্ব)। এছাড়া পদ্মপুরাণে গঙ্গাসাগর তীর্থক্ষেত্রে জনপদ ও অরণ্যের উল্লেখ দেখে বোঝা যায়, ওই গঙ্গাসাগর সুন্দরবনেই ছিল (কালিদাস দত্ত, দক্ষিণ ২৪ পরগণার অতীত, ৪র্থ পর্ব, পৃঃ ৮১-৮২, বাইপুর, ১৯৮৯)। রামায়ণে পূর্ব সমুদ্রতীরের এ অঞ্চলকে পাতাল বা রসাতল বলে উলে¬খ করা হয়েছে। প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সাহিত্যে এ অঞ্চলকে গঙ্গারিডি বা গঙ্গারিদৈ নামে উলে¬খ করা হয়েছে। মহাভারতে এই অঞ্চলের জনজাতিকে সমুদ্রকূলের ¤ে¬চ্ছজাতি বলা হয়েছে। গ্রিকদের বর্ণিত গঙ্গারিডি নামক সমৃদ্ধ রাজ্য এ অঞ্চলে অতি প্রচীনকালে গড়ে উঠে। টলেমি তার মানচিত্রে গঙ্গারিডি রাজ্যের সীমানা চিহ্নিত করে, যার পশ্চিমে গঙ্গা (যা প্রাচীন সরস্বতী ও কংসবতী), পূর্বে গঙ্গা (পদ্মা ও মেঘনা) আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।
ইছামতি ও কপোতাক্ষ বিধৌত এ অঞ্চলের ভূমি গঠন ও জনপদ সৃষ্টি প্রাচীন বলে প্রতীয়মান হয়। চারিদিকে জল, তারপর অরণ্যের নানা রকম গাছ পালা, পাখি, সরীসৃপ, নানা রকমের স্তন্যপায়ী জীবজন্তু ও সবার শেষে মানুষ। প্রথমে ছিল দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল জলরাশী বা সাগর। তাতে নদীর স্রােত পড়ে, পলি জমে, ধীরে ধীরে জল ছেড়ে ভূমি জেগে উঠে। মাঝে মধ্যে নদী খাল থেকে যায়। কিছুদিনের মধ্যে নদী বেশ উষ্ণ হয়। তখন নদী-খালের বিস্তৃতি কমতে থাকে। ক্রমশ জলধারাসমূহ নানাভাবে গতি পরিবর্তন করে। আর মধ্যে চর রেখে যায়, যাকে দিয়াড়া, দিয়া, দহ, মাদিয়া বা দ্বীপ বলে। (মানবাধিকার আন্দোলন প্রেক্ষিত : দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় প্লাবনভূমি অঞ্চল-গৌরাঙ্গ নন্দী ও আশেক-ই-এলাহী)। সেই মানুষেরা এসে আশ্রয় গড়ে তুলেছে যারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে সাগর ও বনের উপর নির্ভর করে টিকে থাকতে পারে। ক্রমাগত দক্ষিণমুখি জনবসতি হয়েছে, এটি প্রচলিত মত।
হিমালয় পর্বতমালার দক্ষিণ পাদদেশে অরণ্যময় অঞ্চলে বাস করত কৃষ্ণাভ, ঘণশ্যামবর্ণ, প্রায় উর্ণাবৎ কেশ, উল্টানো ঠোট, খর্বকায় ও মজবুত পেশীযুক্ত মানবগোষ্ঠী। এ অঞ্চলের জনসৌধের প্রথম স্তর নেগ্রিটো বা নিগ্রোবটুজন। বাগদী বা সুন্দরবনের মৎস্য শিকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিগ্রোবটুর রক্তধারা দেখতে পাওয়া যায়। এ জনগোষ্ঠীর পরবর্তী স্তর আদি-অষ্ট্রিক। নিম্নবর্ণ ও আদি অধিবাসীদের মধ্যে এ ধারার প্রভাব বেশী। উচ্চবর্ণ ও উত্তমসংকর বর্ণের মধ্যে যে গোল ও মধ্যম মুণ্ড আকৃতি, তীব্র ও উন্নত এবং মধ্যম নাসাকৃতি ও মাধ্যমিক দেহ দৈর্ঘ্যরে লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়, তা পরবর্তীকালের অ্যালপাইন ও আদি অষ্ট্রেলীয় নরগোষ্ঠীর দান। বস্তুত, বর্তমানে যে জন (মানুষ) ও সংস্কৃতি শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে গড়ে উঠেছে, তার মূল রূপায়নই অ্যালপাইন ও আদি-অষ্ট্রেলীয় ধারার কৃর্তি। — পরবর্তীকালের আগত আর্য ভাষাভাষী আদি-নার্ডিক নরগোষ্ঠীর রক্ত প্রবাহ ও সংস্কৃতি তার উপর স্তরের একটি ক্ষীণ ধারামাত্র। ( ড. নিহার রঞ্জন রায়, বাঙালির ইতিহাস)।
ভূমি গঠনের পরপরই যে নৃ-গোষ্ঠী এসে আশ্রয় গ্রহণ করে জাতিগতভাবে তারা বাগদী (বাগড়ী) সম্প্রদায়।’ মূলত, গঙ্গা নদীর পলি জমে ওঠার সাথে সাথে এ দ্বীপে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের সৃষ্টি হয় এবং এখানে এসে প্রাচীন মৎস্যজীবী (বাগদী) সম্প্রদায় বসতি স্থাপন করে। এ জনগোষ্ঠীই এ অঞ্চলের আদিমানুষ। তারা পূর্বে বংশ পরম্পরায় গঙ্গা পদ্মার পশ্চিম-উত্তরে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছিল। ক্রমশঃ সমুদ্র দক্ষিণে সরেছে। বসতিও দক্ষিণে সরেছে।’ (ব্যঘ্রতট পরিক্রমা )।
সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে মানুষের উদ্ভব ও বিকাশ। সুন্দরবনের গাছ থেকে হাজার হাজার টন পাতা নদীতে পড়ে। আর এ পাতা পঁচে যে পরিবেশ তৈরী করে সেটি মৎস্য প্রজাতির প্রধান খাদ্য। ফলে সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে বঙ্গোপসাগরের কূলে মাছের এক বিশাল আধার গড়ে ওঠে। আর এ মৎস্য প্রজাতির উপর নির্ভর করে আদি থেকে যে জনগোষ্ঠী সামুদ্রিক দুর্যোগ আর জঙ্গলের হিং¯্র প্রাণীর সাথে লড়াই করে সুন্দরবনের মা বনবিবির সন্তান হিসেবে মনুষ্য বসতির অস্তিত্ব তুলে ধরেছে, তারা হলো সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সম্পদ হারানো জনগোষ্ঠী বাগদী সম্প্রদায়।
হিমালয়ের দক্ষিণ পাদদেশে কালো চামড়ার যে মানুষগুলো, উত্তরের সাদা চামড়ার আর্যদের আক্রমণে পিছু হটতে হটতে সাগরকূলে আশ্রয় নিয়ে সুন্দরবন অঞ্চলে মনুষ্য প্রজাতির বিকাশ ঘটায়, তারা হলো আমাদের আদি-পুরুষ বাগদী সম্প্রদায়। সুন্দরবন অঞ্চলের কৃষ্টি সংস্কৃতি বিশেষ করে লোক সংস্কৃতির জনক ও ধারক হলো বাগদী সম্প্রদায়। এ অঞ্চলে মা বনবিবিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ঝুমুর যাত্রা, দুখেযাত্রা, বনবিবির পালা, গাজির পালা এখনও ধরে রেখেছে বাগদীরা। মনষার পালা, যা বাংলা ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত সেটিও বাগদীরা লালনকারী। কীর্তন, রামায়ণ, জারী, কবিয়াল, ভাটিয়ালী ইত্যাদির ধারকও এই অঞ্চলের বাগদীরা। (দক্ষিণদেশ: সম্পাদকীয়-আশেক-ই-এলাহী)।
’বৈদিক পুরাণ মতে, স্থানীয় মানুষরা অনার্য ছিল। তাদের ধর্ম জ্ঞান ও খাদ্য বিচার ছিল না। এসব গ্রন্থে চতুর্থ ও ৬ষ্ঠ শতকে সমুদ্র উপকূলীয় বাংলাকে সমতট এবং আরো পরে উপবঙ্গ, অযুত্তব বঙ্গ, বঙ্গাল, বাঘ্রতটী প্রভৃতি নামে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনপদ রূপে চিহ্নিত করার নির্দশন পাওয়া যায়। এর মধ্যে পুন্ডু একটি কোম (ঞৎরনব), প্রাচীন জাতির নাম। ইতিহাস বেত্তাদের মতে, কোলসবর, হাড়ি, ডোম, চন্ডাল প্রভৃতি জাতি প্রাচীনকালে বসবাস করতো। কারো মতে, তারা নিষাদ, কারো মতে তারা চন্ডাল। এই জাতিই বাগড়ী অঞ্চলে বসবাসের জন্য বাগদি নামে পরিচিত হয়েছে। তবে তাদের নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ছিল অষ্ট্রোলয়েড।’ (বাঙালির ইতিহাস- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যঘ্রতট পরিক্রমণ)।
এ অঞ্চলের মূল নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য হলো আদি-অস্ট্রোলয়েড। কোল, ভীল, মুন্ডা, সাওতাল, শবর, বা পৌন্ড্রত্রীয়, ব্যাঘ্রত্রীয় প্রভৃতি মিলিত ধারার মানুষ। অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড় বংশক্রমিকতার নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। এর সাথে যুক্ত মোঙ্গলীয় রক্তধারা। পরবতীতে নর্ডিক গোষ্ঠীর (আর্য) সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে লাভ করেছে এক অন্যন্য বৈশিষ্ট্য। তাই উচ্চ বর্ণের হিন্দু, নিম্ন গোত্রের হিন্দু, মুসলিম, খৃষ্টান সবাই নৃ-তত্ত্বের বিচারে একই।
খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের জন্ম। এ দু’ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রাচীন মূর্তি পুরাতাত্ত্বিক খননে পাওয়া গেছে। ভারত ভায়না বৌদ্ধ ধর্মের নির্দশন আজও আছে। এ অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের শাসনকাল দীর্ঘ সময় ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। সেন বংশের রাজত্বকাল চলে, যশোরশ্বরী মন্দির সেন স্থাপনার নির্দশন। মোঘল স্থাপনা রয়েছে অনেকস্থানে। খাজা খানজাহান আলীর আগমনে ইসলাম ধর্মের প্রসার শুরু হয়। তবে, খান জাহান আলী আসার আগেও মুসলিম বসতি ছিল অনেকের মত।
বসন্ত রায় বির্নিমিত রাজ্য এ অঞ্চলের সবচেয়ে পরিচিত ও সমৃদ্ধ রাজ্য ছিল। প্রতাপাদিত্য যার রাজা ছিলেন। প্রতাপাদিত্য আদি যমুনাকূলে এক সমৃদ্ধ জনপদের পত্তন করেছিলেন। যার সৈন্যবাহিনীতে ছিল এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা। যারা ছিল প্রচন্ড সাহসী, তীরধনুক চালানো ও খিপ্রগতিতে নৌকা চালাতে পারদর্শী। এ বাহিনীতে মগ-পর্তুগীজ জলদস্যুরাও ছিল। প্রতাপাদিত্য তার তীব্র বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মগ-পর্তুগীজ জলদস্যুদের বশ্যতা স্বীকার করান। মোঘল বাহিনীর সাথে যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সে রাজ্যের পতন ঘটে। যশোর রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের স্বাধীন রাজ্যের পতন ঘটে। আবার আস্তে আস্তে জঙ্গলাকৃণ্য হয়ে পড়ে সমগ্র অঞ্চল। তবে আভিজাত উচ্চস্তরের ব্যক্তিদের প্রত্যাগমনের মাধ্যমে এলাকার পরিবর্তন শুরু হলেও এক দল ভূমিপুত্র বাদা-জঙ্গলে থেকে যায়।
১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর মীরজাফর নবাব হয়ে পুরো সুন্দরবন ও ২৪ পরগানার পত্তন নিলেন। অর্থাৎ ভারতে বৃটিশ সা¤্রাজ্যের প্রথম অধিকৃত এলাকা হলো সুন্দরবন। ইংরেজরা সুন্দরবনের মালিক হয়ে সুন্দরবনে কৃষিজমি তৈরি করে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে যশোর জেলা প্রশাসক মি. টিলম্যান হেঙ্গল ও গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসকে জানান। হেঙ্গল সাহেব ১৪৪ জন জমিদারকে সুন্দরবন সংস্কারের জন্য ঠিকাদার নিযুক্ত করেন। কয়েকটি শর্তে এ ঠিকাদারী প্রদান করা হয়। যার মধ্যে ছিল-নির্ধারিত এলাকাতেই বন হাছিল করতে হবে, প্রথম তিন বছর কোন খাজনা দিতে হবে না। ১৭৮৪ সালের ৩ এপ্রিল হেঙ্গল সুন্দরবনের সীমানা নির্ধারণ করেন। পরে হেঙ্গল সাহেবকে সুন্দরবনের সুপার নিযুক্ত করা হয়। হেঙ্গলের চেষ্টায় রায় মোঙ্গল থেকে হরিণঘাটার মধ্য পর্যন্ত বন কেটে ৬৪,৯২৮ বিঘা কৃষিজমি পত্তন দেওয়া হয়। এ সময় জঙ্গল আবাদ করার জন্য মেদিনীপুর, বিহার এমনকি ছোট নাগপুর থেকে গরীব মজুরদের আনা হয়। তাদের অধিকাংশই আদিবাসী সাওতাল, মুন্ডা, মাহতা ছিল। এ অঞ্চলে প্রধানত মুন্ডা ও মাহতারাই ছিল।
সাগর, বন, আর ভূমিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে এ মানুষের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। যা সম্পূর্ণরূপে ছিল পেশা কেন্দ্রিক। বৈচিত্র্যে ভরা ভয়াল অথচ সম্পদশালী প্রকৃতি নির্ভর এই অরণ্য দক্ষিণ জনপদের সাহসী মানুষদের জীবন ও জীবিকা। দক্ষিণ বাংলার সমুদ্র উপকূলে স্থাপিত জনপদের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য অভিনব ও বৈচিত্র্যময়। মানবতাবাদী, আবেগময়ী, প্রেরণা সৃষ্টিকারী এক অপূর্ব সাংস্কৃতিক ধারা তৈরি করে প্রকৃতিনির্ভর মানুষেরা। এ অঞ্চলের বৃহৎ গণমানুষের সামগ্রিক কৃষ্টি-সংস্কৃতি নির্মিত হয়েছে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের মাধ্যমে।
জনবিন্যাসের দিক থেকে দেখলে এলাকার আদি অধিবাসীরা নর্কিড শ্রেণির অনার্য বংশোদ্ভুত আদি অষ্ট্রোলয়েড। আর্য বা সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আগমন ঘটেছে দু’হাজার বছর আগে। বৌদ্ধ ধর্মের আগমন ৬’শ বছরের। আর মুসলিম আগমন প্রায় এর পরপরই। তার শ’ খানেক বছর পরে প্রত্যাপাদিত্যের রাজত্বকালে আগমন ঘটে পর্তুগিজ খিষ্ট্রানদের। এভাবে একে একে নানান জাতির আগমন ঘটেছে এ এলাকায়। স্থানীয় নিম্নবর্গীয় অধিবাসী, যেমন- পোদ, চাড়াল, নমশুদ্র, বাগদি, শিকারী প্রভৃতি এদেশের আদিবাসী। আর এর সাথে যুক্ত হয়েছে আর্য, বৌদ্ধ, জৈন্য, সেন, মুসলিম ও ইংরেজ জনসম্প্রদায়ের রক্ত ধারা। এ সব দেশী বিদেশী মানবগোষ্ঠীর সম্মিলনে যেমন সম্প্রসারিত হয়েছে মানব সমাজ, তেমনিভাবেই এগিয়েছে কৃষ্টি-সংস্কৃতি।
জীবন ও জীবিকাকে কেন্দ্র করে প্রকৃতি নির্ভর এ জনসম্প্রদায়ের মানুষদের ধর্ম বিশ্বাসও সেভাবেই গড়ে উঠে। প্রকৃতির সন্তান হিসেবে প্রকৃতির বিভিন্ন কর্মকান্ড তাদের মধ্যে এক ধরনের অন্ধ বিশ্বাসের জন্ম দেয়। আর্য আগমনের মাধ্যমে অধিকাংশই সনাতন হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে পড়েন। তবে পুরাতন ধ্যানধারণাগুলোও একইভাবে টিকে থাকে। হিন্দু ধর্মের বর্ণপ্রথার শিকার হওয়ায় পরবর্তীতে বৌদ্ধ ধমের্র আগমনে অধিকাংশই বৌদ্ধ ধর্মে যোগ দেয়। গুপ্ত যুগ হতে হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানে অধিকাংশই আবার হিন্দু ধর্মের আচরণে ফিরে আসে। সেন রাজত্বকালে নাথ সম্প্রদায় যৌগী’রা বৌদ্ধাচার বজায় রাখতে যেয়ে নিদারুণ নিগ্রহের স্বীকার হন। এ কালের যৌগী সম্প্রদায় তাদের বংশধর। (তথ্য সূত্র: সাতক্ষীরার উপভাষা: স্বরূপ ও স্বাতন্ত্র্য, কাজী মুহাম্মদ অলিউল্লাহ)।
এ অঞ্চলে রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণসমাজ ছিল সমধিক প্রবল। অনেককাল ধরে উচ্চবর্ণের গুরু পুরোহিত রূপে বৈদিক ব্রাহ্মণ এদেশে বাস করতেন। এরা অধিকাংশ পাশ্চাত্য বৈদিক। এদের গোত্র সংখ্যা ২৪টি, তত্মধ্যে সান্ধিল্য, বশিষ্ঠ, ভরদ্বাজ, স্বাবর্ণ ও স্থানক- এই পঞ্চগোত্র প্রধান। দক্ষিণাঞ্চল একসময় রাঢ়ীয় কুলিনদের প্রধান স্থান ছিল। বল্লাল সেন রাঢ়ীয়দের মধ্য হতে বাছিয়া কৌলিণ্য দেন। পরবর্তীতে রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ সমাজ চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় : ১. কুলীন ২. শ্রোত্রীয় ৩. ভঙ্গকুলীন ও ৪. বংশজ (মিত্র:১১১৮-২০)। কণৌজাগত পঞ্চ ব্রাহ্মণদের সঙ্গে যে সব ব্রাহ্মণ এদেশে আসেন তাঁরা সপ্তস্বতী পর্যায়ভুক্ত। এদের মধ্যে ‘কাটানি’ বংশ উলে¬খযোগ্য। তাছাড়া সম্ভবত, মানসিংহের পার্শ্বচর রূপে প্রতাপাদিত্যকে নিগৃহীত করার জন্য এক সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণেরা এদেশে আসেন এবং প্রত্যাগমনকালে সেই সকল পাঁড়ে, তেওয়ারী (ত্রিবেদী), মিশ্র প্রভৃতি হিন্দুস্তানি ব্রাহ্মণেরা বসতি স্থাপন করেন।
বল্লাল সেনের পূর্বে বৈদ্য বংশে সিদ্ধ, সাধ্য ও কষ্ট এই তিন শ্রেণি ছিল। তন্মধ্যে সিদ্ধগণ বল্লালের নিকট কৌলিণ্য পান। এদের মধ্যে আটজনকে মহারাজ লক্ষণ সেন মূখ্যাষ্ট কুলীণ বলে চিহ্নিত করেন; শক্তি গোত্রীয় দুহি ও শিয়াল, ধন্বন্তরি গোত্রীয় বিনায়ক ও গয়ি, মৌদগল্য গোত্রীয় চায়ূ পন্থ এবং কাশ্যপ গোত্রীয় ত্রিপুুর ও কায়ু। এদের মধ্যে প্রথম চারজনের উপাধি ‘সেন’ ‘চায়ূ’ ও পন্থের উপাধি ‘দাস’ এবং ত্রিপুরা ও কায়ূর উপাধি ‘গুপ্ত’। ‘সেন’ ও ‘দাস’ উপাধির সঙ্গে ‘গুপ্ত’ উপাধি যুক্ত হয়। এই সর্ব সম্প্রদায়ের কুলীনগণ সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে বাস করতেন। এদের বঙ্গজ বৈদ্য বলা হয়। (মিত্র, প্রাগুক্ত: ১১২১)।
সতীশচন্দ্র মিত্র আরো বলেন যে, ‘বঙ্গজ’ ও ‘রাঢ়ীয় কায়স্থরা’ দক্ষিণাঞ্চলে বাসস্থান গড়ে তোলেন। বসন্ত রায় সর্বজাতীয় প্রধান কুলীণ এনে ‘যশোহর সমাজ’ গড়ে তুলেছিলেন। বঙ্গজদের মধ্যে বসু, ঘোষ, মিত্র ও গুহ কুলীন কায়স্থ হিসেবে গণ্য হন। এছাড়া দত্ত, দাস, মিত্র ও নাথ এই চার ঘর ছিলেন মধ্যল্য এবং দেব, রাহা, সেন, সিংহ প্রভৃতি ১৯ ঘর মহাপাত্র বঙ্গজ সমাজভুক্ত। এদের মধ্যে তিন শ্রেণির কুলীন বংশজ এবং মৌলিকদের মধ্যে দত্ত ও দাস বংশ আধুনিক যশোর সমাজে বর্তমান। মিত্র বা অন্য মৌলিক বংশ বর্তমানে নেই। বল্লালী যুগে রাঢ়ের দক্ষিণ ভাগে ভাগীরথী প্রবাহের দক্ষিণকূলের অধিবাসীরা ছিলেন। তাঁরাই দক্ষিণরাঢ়ী সমাজভুক্ত। অন্যান্য মৌলিকদের মধ্যে মজুমদার, ভজ্ঞচৌধুরী, পাল, পালিত, রাহা, নাগচৌধুরী, সোম, সরকার, নন্দী, ব্রহ্মাচন্দ্রগণ কায়স্থ সমাজে সম্মানিত। বঙ্গ সমাজের ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থ এই তিন বর্ণের নিচে যাঁদের আসন তাঁরা নয় শাখায় ‘নবশাখ’ নামে পরিচিত। এঁরা হলেন- গোপ, মালাকার, তৈলিক, তন্তবায়, মোদক (ময়রা), বারুজীবী, কুম্ভুকার, কর্মকার এবং নমশূদ্র বলে পরিচিত। বণিকদের ভেতর গন্ধবণিক, শঙ্খবণিক, সুবর্ণবণিক ও কংসবণিক নবশাখতুল্য। যুগ যুগ ধরে এসব মানুষের বাস এই ভূখন্ড। প্রাচীনকাল থেকে সুমুদ্রবেষ্টিত সুন্দরবনের চরাঞ্চলে লবণ উৎপাদিত হতো। এ চাষের মূল শ্রমিকরা ‘মঙ্গলী’ নামে অভিহিত। উড়িষ্যা, বিহার ও পশ্চিম বঙ্গের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা থেকে যে সব অভিবাসী শ্রমিকের আগমন ঘটে তাদের মধ্যে ‘মুন্ডাই’ প্রধান। এরা কাঁকড়া, কুচে, শামুক, ঝিণুক, কচ্ছপ, ইঁদুর, কাঠবিড়ালি খায়। মৃত মুন্ডাদের মুসলমানদের মতো কবর দেয়া হ’লেও কাফন পরানো হয় না। বিয়ের সময় এরা নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পালন করে।
এ অঞ্চলে ‘কর্তাভাজ’ ও ‘ভগবেনে’ সম্প্রদায়ের বাস দীর্ঘকাল যাবত। সতীশচন্দ্র মিত্র এই দুই সম্প্রদায়ের ব্যাখ্যায় বলেন যে, ভগবেনেরা (ভগবানিয়া) নিগৃহীত হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের এক বিদ্রোহী সম্প্রদায়। আর কর্তাভজা সম্প্রদায় হিন্দু, মুসলমান স্থানীয় তফশিলি শ্রেণির মধ্যে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণকারী কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠী। বর্তমানে উভয় শ্রেণি জনসাধারণ্যে ‘ভগবেনে’ (ভগোবেইনে) হিসেবে অভিহিত হলেও নিজেদেরকে ‘কর্তাভজা’ বলে দাবি করেন। ফলে, এই দুই শ্রেণির আর আলাদা অস্থিত্ব লক্ষ করা যায় না। এইধর্ম সম্প্রদায় আউয়াল চাঁদ বা আউল (১৬৮৬-১৭৬৯) চাঁদকে তাদের ধর্মের প্রবর্তক বলে মান্য করেন। এদের আগমন ঘটে সতেরো শতকে। যতদূর জানা যায়, আউল চাঁদ ছিলেন চৈতন্যদেবের অনুসারী এবং অনেকটা বৈষ্ণবভাবাপন্ন। নতুন ধর্মমতের অনুসারী ‘ভগবেনে’ সম্প্রদায় তিনটে শ্রেণিতে বিভক্ত। এক শ্রেণির নাম মুসলমানদের মতো। মুখে দাড়ি রাখে। মাছ খায়, মাংস খায় না, অসুখে কিছু ওষুধ-পথ্য ব্যবহার করে। অপর শ্রেণি হিন্দুভাবাপন্ন। এদের নাম হিন্দুদের মতো। মাছ-মাংস, ওষুধ-পথ্য কিছুই খায় না। অসুখে উপোস করে ও অনেকে মাটিকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করে।
উপকূলীয় অঞ্চলে মুসলমানদের আগমন সম্পর্কে সঠিক তথ্য মেলে না। এ.এফ.এম. আবদুল জলীলের মতে, পীর খান জাহান আলীর আগমনের পূর্বে এ অঞ্চলে মুসলমানদের আগমন ঘটে। খান জাহান আলীর শিষ্যবর্গের কাছে বহু তফশিলি সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণ করেন। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে মুসলিম শাসনামলে এ অঞ্চলে বহিরাগত মুসলমানদের অনেকে এসে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন। এঁদের মধ্যে রাজকর্মচারি, ভাগ্যান্বেষী, পলাতক, ধর্ম প্রচারক প্রভৃতি উলে¬খযোগ্য। এরা সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
বৌদ্ধ যোগী সম্প্রদায়ের কিছু লোক বিচ্ছিন্নভাবে বাস করেন। পালযুগ থেকেই বংশপরম্পরায় এঁদের বসবাস। তবে, চাল-চলন, নাম গ্রহণ, ধর্মীয় অনুশাসন সম্পূর্ণ হিন্দুদের মত। সুন্দরবনাঞ্চলে খ্র্র্র্র্রিস্টান সম্প্রদায়ের আগমন ঘটে প্রতাপাদিত্যের রাজত্বকালে। তবে, তারও আগে ভগ্ন পুরোনো গির্জার সন্ধান পাওয়া যায়, যা থেকে মনে হয় বহু পূর্ব থেকে খ্রিস্টানদের বসবাস ছিলো। ব্রিটিশ আমলেই নিম্ন শ্রেণির হিন্দুদের অনেকেই খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে।
সতীশচন্দ্র মিত্র ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন: মুসলমানদিগের দুইটি শ্রেণি শিয়া ও সুন্নি। এলাকার মুসলমানদিগের অধিকাংশই সুন্নি। তিনটি শ্রেণি- ১. আশরাফ ২. আতরাফ ও ৩. আরজাল।
১. আশরাফ সম্প্রদায়: এই শ্রেণির মুসলমানগণ সৈয়দ, মোঘল, পাঠান ও শেখ এই কয়টি প্রধান সম্প্রদায়ভুক্ত। সৈয়দ উচ্চ শ্রেণির। শেখ, মীর্জা ও বেগ প্রভৃতি উপাধিধারী মোঘল; খাঁ, মলি¬ক, মীর প্রভৃতি উপাধিযুক্ত প্রধান; আখন্দজি, খোন্দকার, মুন্সি এবং কাজী এই সকল বংশ প্রধান আওতাভুক্ত।
২. আতরাফ সম্প্রদায়: এই সম্প্রদায়ের মুসলমানগণের মধ্যে শেখই অধিক। তা ছাড়া জোলহা, নিকারী, চাকলাই, দরজী ও পীরালি প্রভৃতি এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
৩. আরজাল সম্প্রদায়: নিম্নতম স্তরের অনাচরণীয় মুসলমান এই শ্রেণিভুক্ত। এই শ্রেণির মুসলমাদের সঙ্গে আশরাফ ও আতরাফ কোন সমাজের সম্পর্ক চলে না। যেমন পাটানি, ধোপা, নাপিত, কাহার, মালি প্রভৃতি এই শ্রেণিভুক্ত। (মিত্র, দ্বিতীয় খন্ড, দ্রা. সম্পা, চৌধুরী, কমল: ১১৩৬)।
এছাড়া আছেন মাজহাবপন্থি ও লা-মাজহাবি। যারা মাজহাব মানেন না তারা নিজেদেরকে ‘মোহাম্মাদী’ বলে উলে¬খ করেন। এদের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। অবশ্য সুন্নিদের সংখ্যা সর্বাধিক এবং জেলার সর্বত্রই তাঁরা বাস করেন। বিচ্ছিন্ন কিছু জমাদারও আছে (মেথর ও মুর্দফরাশ)। মুসলিমদের একটি ধারা আহমাদিয়া সম্প্রদায়। যারা স্থানীয়ভাবে কাদিয়ানী নামে পরিচিত। বাহাই সম্প্রদায় আর একটি ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী। এরা সংখ্যায় খুবই নগণ্য। বাহাই ও আহমাদিয়ারা ধর্মীয় কিছু বিধি-নিষেধ ছাড়া অন্যান্য সকল বিষয়ে মুসলমান রীতি অনুসরণ করে থাকেন। তারা কর্ম ও ব্যবসার সূূূূূূূত্রে দেশের এমনকি বিদেশের বহু এলাকায়ও স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন (তথ্য সূত্র: সাতক্ষীরার উপভাষা: স্বরূপ ও স্বাতন্ত্র্য, কাজী মুহাম্মদ অলিউল¬াহ)।
দক্ষিণ বাংলায় আর্য অনুপ্রবেশের পর থেকে স্থানীয় মানুষদের মুখের ভাষায় রচিত গাথা এবং আর্য বিজেতাদের সাহিত্যের মিলনে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ তথা ব্যঘ্রতট মূলে একটি পৃথক সাহিত্যধারা গড়ে উঠে। এই ধারা সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত। প্রাচীন যুগে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে জ্ঞানচর্চার জন্যে স্থানীয় প্রাকৃতজনদের কথ্য ভাষাকে ব্যাকরণসম্মত, শুদ্ধ ও সংস্কার করে বক্তব্য পেশ করার জন্য একটি সর্বজনগ্রহ্য রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সেই যুগে বাঘ্রতটে কলাঘ্র বর্মার ‘সারাবলী’ নামে একটি মাত্র জ্যোতিষ শাস্ত্রীয় গ্রন্থের খবর পাওয়া যায়। (বাঘ্রতট-১৬১) ।
কবি মনোরথের লেখা কোলি লিপিতে নৌযুদ্ধের বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘দক্ষিণ বঙ্গে তার বিজয় অভিযানে নৌবহরের হী হী শব্দে ভীত হয়ে দিগগজেরা যে পালিয়ে যায়নি তার কারণ তাদের যাবার কোন জায়গা ছিল না। তাছাড়া দাঁড়গুলোর উর্দ্ধমুখি আঘাতে উৎক্ষিপ্ত জলরাশি যদি আকাশে স্থির হয়ে থাকতো, তা হলে চাঁদের কলঙ্ক যে ঢাকা পড়ে যেত।’
এ নিদর্শন আমাদের প্রাচীনযুগকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সে সময় ‘সংস্কৃত’ ভাষা ছিল রাজভাষা এবং হিন্দুধর্মের বর্ণভেদ প্রথা প্রবল থাকায় স্থানীয় লোকায়ত ভাষা সাহিত্যের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। কিন্তু পরবর্তী যুগে লোকায়িত ভাষায় লোকসমাজ উঠে এসেছে সাহিত্যে, যার নির্দশন চর্যাপদে খুঁজে পাওয়া যায় (ব্যঘ্রতট-৭৪)।
ড. মুহাম্মদ শহীদুল¬াহর বিবরণানুযায়ী আদি কবি মীননাথ বা মৎসেন্দ্রনাথ দক্ষিণ বাংলার কবি। তাঁর কবিতা ও চর্যাপদের বিভিন্ন কবিতায় উলি¬খিত তথা চর্চাকারদের অধিকাংশের কবিতায় নদী, সাঁকো, হরিণ, কুড়েঘর, ডোম্বী (নিম্ন তফশিলি শ্রেণির মহিলা) যে পরিচয় পাওয়া যায় তা সুন্দরবনাঞ্চলেরই প্রতিচ্ছবি বললে অত্যুক্তি হয় না। ব্যঘ্রতট অঞ্চলের লোকায়ত জীবনের আনন্দ-বেদনা, আবেগ-আর্তি ধ্বনিত হয়েছে সুদূর আদি ও মধ্যযুগ থেকে। যবন হরিদাসের রচনা, প্রতাপাদিত্যের বন্ধুকবি অবিলম্ব স্বরস্বতী ও তার ভাই ডিম ডিম, প্রতাপাদিত্যের রাজকবি এবং বিখ্যাত পদকর্তা গোবিন্দ দাস এর রচনায় দক্ষিণ অঞ্চলের সাহিত্যের ছাপ আছে। গাজীকালু চম্পাবতি, দক্ষিণ রায়, দুখে-বনবিবির কাহিনী, ভরতচন্দ্রের অন্নমঙ্গল কাব্যের ভবানন্দ উপখ্যান ও মির্জানাথের বাহারইস্থান-ই-গায়েবী’র সমরকাহিনী আর স্থানীয় শক্তিমানদের জীবননির্ভর বিষয়ভিত্তিক লোকায়িত স্বভাব কবিদের রচনা এ অঞ্চলের সাহিত্যের ক্ষীণধারার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পাশাপাশি তুক-তাক, ঝাড়-ফুক, জীন-পরি, পীর-ফকির-তান্ত্রিক, দেব-দেবীর মহাত্ম বর্ণনায় সাহিত্যের ক্ষীণধারা তৈরি করে। (কাজী মুহাম্মদ অলিউল¬াহ : সাতক্ষীরার উপভাষা স্বরূপ ও স্বাতন্ত্র্য)।
হিমালয় প্রবাহ যেমন বিভিন্ন স্থানে পলি নিয়ে সাগরবুকে ব-দ্বীপের সৃষ্টি করেছে তেমনি স্থানীয় প্রাকৃতজনদের সাথে নানান জাতি, গোত্র ও ধর্মের সংমিশ্রণে সৃষ্ট হয়েছে এক পৃথক সাংস্কৃতিক ধারা। যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জীবিকা ও টিকে থাকার নিরন্তর সংগ্রামের মধ্যদিয়ে সৃষ্টি। ফলে এ সংস্কৃতি হয়ে ওঠে জীবন সম্পৃক্ত ও মানবতাবাদী। কখনই প্রাধান্য পায়নি সাম্প্রদায়িক চেতনা। সাগরের বিশলতা মানুষের হৃদয়কে বিশাল করেছে। বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী বা ধর্মপ্রচারকগণ স্ব-ধর্ম প্রচার করে থাকলেও তা স্থানীয় মানুষের ধ্যান-ধারণা, কৃষ্টি, বিশ্বাসকে প্রভাবিত করতে পারেনি। ফলে ধর্ম পৃথক হলেও উৎসবসমূহ হয়েছে সকলের। এ সকল উৎসবসমূহ প্রায় সবই জীবিকা বা পেশা কেন্দ্রিক। ফসল বোনা, তোলা, সুন্দরবনে যাওয়া অথবা বিনোদনের সময় বিভিন্ন লোকযাত্রা, পালাগান সকলের সম্পৃক্ততার এক অপূর্ব নিদর্শন এখানে আছে। প্রধান তিন ধর্মীয় গোষ্ঠীর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এত কাছাকাছি আর কোথাও আছে কিনা বলা মুশকিল। (ঈশ্বরীপুরে মসজিদ, মন্দির ও গীর্জার অবস্থান)।
দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে বাদা কেটে আর প্রকৃতির সাথে লড়াই করে যে জনপদ বা বসতি স্থাপিত হলো তার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য অভিনব। মানুষের জীবন সংগ্রামের সাথে যুক্ত। এ অঞ্চলের গণমানুষের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের বৈশিষ্ট্য তাই নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায় ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মিলিত এক অসম্প্রদায়িক গণ-সংস্কৃতি। মদিনা বিবি, বনবিবি ও দক্ষিণা রায় সকল বনজীবীদের আরোধ্য দেবতা।
সাগরে যাওয়া এক অনিশ্চিত ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হলেও প্রিয়জন বিচ্ছিন্ন হয়ে এ পথেই জীবিকার জন্য যাত্রা করতে হয়েছে মানুষকে। এ যাওয়ার সময় যে জীবন থেকে যে করুণ আর্তি বের হয়ে আসে, তা থেকেই উদ্ভব ভাটিয়ালী গান ও সুরের। আর সাগর থেকে ফেরার যে আনন্দ, প্রিয়ার সাথে মিলনের আকাঙ্খা, তা থেকেই চটুলতার সুর সৃষ্টি- সেটি সারিগান। কোথাও আবার স্বামীর বাড়িতে কষ্টে আছে অথবা বিরহে আছে- সে আবেগ বা আকুতি ভাটিয়ালি গানের মধ্যে পাওয়া যায়। লোকসংগীতের একটি প্রধান মাধ্যম কীর্তন। যা এলাকার সকল সংগীতকে প্রভাবিত করেছে। পালাগান, পদাবলি কীর্তন, রামায়ন, কবি, জারীগান, মনষার ভাষান, শীতলার বয়ানী ইত্যাদি।
এখানকার অন্যতম লৌকিক দেবী মদিনা বিবি। এটি স্থানীয় মুসলমানদের আরাধ্য দেবী। মানিক পীরের গান আরো একটি মুসলমানীয় লোকধারা। গৃহপালিত পশুপাখির রক্ষাকারী দেবতা। বনবিবি সুন্দরবনে গমনকারী সকলের দেবতা।
দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় প্লাবনভূমি অঞ্চলের মানুষের জীবন প্রবাহ আবর্তিত হয়েছে সুন্দরবন, সাগর আর ডাঙাকে কেন্দ্র করে। অন্যদিকে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা আর সাগর-জঙ্গলের হিংস্র প্রাণির সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়েছে। যার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে সংস্কৃতি। ফলে এ অঞ্চলের সংস্কৃতি মানবতাবাদী, আবেগময়ী ও সংগ্রামী চেতনার ভিত্তিকে ধারণ করেছে। আবার লোকবিশ্বাস, লোকঐতিহ্য, যাদুটোনার প্রভাব যুক্ত হয়েছে। একইভাবে বিভিন্ন ধমীয় জাতিগোষ্ঠীর আগমন এ সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। তবে কখনই প্রান্তজনের আদি কৃষ্টি-ঐতিহ্যের শিকড় বিচ্ছিন্ন হয়নি। আর এটাই সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য।
এতক্ষণ ধরে আলোচনার মাধ্যমে এ জনপদের ভূমি-গঠন ও মানব সম্প্রদায়ের বসতি স্থাপনের ধারাবাহিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এ আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হয় যে, এটি একটি প্রাচীন জনপদ এবং এখানে বহুকাল আগে থেকেই মানুষের বসবাস শুরু হয়েছে। সনাতন ধর্ম বিশ্বাসে বিশ্বাসী প্রাকৃতজন এই মানুষের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ভিত্তি নানান জাতি ও গোষ্ঠীর সংমিশ্রণে গড়ে উঠলেও এলাকার মানুষেরা বিশ্বাসের দিক থেকে মাটি কেন্দ্রিক ও জীবিকা নির্ভর মূল্যবোধকে লালন করেছে। পেশা নির্ভর ও জীবিকা নির্ভর এলাকার লোকসংস্কৃতির সাথে সুফিবাদের মরমী ধারা ও শ্রীচৈতন্যের প্রেম ধারার অপরূপ সমন্বয় ঘটেছে উপকূলীয় সংস্কৃতিতে।
পুনঞ্চ: জলের মধ্য থেকে উদ্ভব ভূমির। ভূমিতে বৃক্ষ, বনায়ন। সৃষ্ট হয় নদীর প্রবাহ। নদীতে তৈরি হয় মাছসহ বিভিন্ন জলজপ্রাণীর, বনে আসে পশু-পাখিসহ নানা প্রাণী। আসে মানুষ। অপূর্ব এক অবস্থা তৈরি করে জল-ভুমি-বন-বৃক্ষ-পশু-পাখি-মাছ এবং মানুষের সম্মিলনে। একটির বিচ্ছিন্ন অপরটি নয়। প্রত্যেকটি প্রত্যেকটির উপর নির্ভরশীল ও পরিপূরক। আর এ সম্মিলন হলো দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের বৈচিত্রময় সংস্কৃতির মূল ভিত্তি। তাই বৃক্ষ ধ্বংশ হলে, নদী মরে গেলে, অস্থিত্বের সংকটে ভোগে মানুষ। ছন্দের পতন হয় প্রকৃতির। বিপর্যয়ের হুমকিতে থাকে সকল প্রাণিকুল