Site icon Daily Dakshinermashal

আছে দুঃখ আছে মৃত্যু তবু আনন্দ জাগে

Spread the love

॥অজয় দাশগুপ্ত॥

১. বাংলাদেশের রাজনীতি বড় জটিল। সে যাকে কেউটে হিসেবে জন্মাতে দেখে তাকেই দেখে বিষহীন হয়ে মরতে। শুধু সংখ্যাগুরু না হিন্দুদের বেলায়ও নিতাই, গৌতম, সুনীল গুপ্ত বা গয়েশ্বরের কমতি নেই। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সেদিক থেকে আদর্শে অটুট ছিলেন। যৌবনে বাম এমনকি তেহাত্তরের সংসদে একা লড়লেও পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। না দিলে লীগের কি হতো জানি না, তবে আজ তিনি যে আবহে, যে প্রচারে বিদায় নিলেন সেটা হতো না। কারণ বামরা এখন লেজে জীবন বাঁচা সাপের মতো। সুরঞ্জিত বাবু প্রতিকূল সমাজ ও রাজনীতিতেও জিতে বেরিয়ে আসতেন। এরশাদের আমলে পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক উস্কানির সময় আমি দুজন নেতাকে সিলেট সার্কিট হাউসে দেখেছিলাম। টানটান উত্তেজনার ভিতর প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদ তার কথা বলে চলে যাবার পর সুরঞ্জিত বাবু তখনকার যুবকদের তার কথার যাদুতে এক করে সামাল দিয়েছিলেন। পাঠিয়েছিলেন দুর্ঘটনা রোধ করতে।

সমালোচনা করা যেতেই পারে। ধোয়া তুলসীপাতা ছিলেনও না। কিন্তু আজকের নেতাদের শেখার মতো অনেক গুণ ছিল তার। সংবিধান ভেজে খাওয়া তিনি ছাড়া মওদুদ-সাকা চৌধুরীদের সামাল দেওয়ার লোক ছিল না লীগে। তার মৃত্যুতে শেখ হাসিনার পাশাপাশি খালেদা জিয়ার বিবৃতিও পড়ে দেখার মতো। ফখরুল সাহেব তো এও বলেছেন, তিনি ছিলেন সৎ মানুষ। তারপরও একদল মানুষ কোনোদিন মানেনি মানবেও না। দিশেহারা পঁচাত্তর পরবর্তী রাজনীতিতে যাদের কথা ও কাজে ভরসা পেতাম তিনি তাদের একজন। তুখোড় বক্তা, সুরসিক, কৌতুকপ্রবণ, ঝানু সাংসদের জীবনও ছিল আগাগোড়া বর্ণাঢ্য। ভালো-মন্দ, মান-অপমান মিলিয়ে এক মুখরিত জীবনের অধিকারী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ব্যক্তিগত স্মৃতি বা অন্য আলাপ হবে পরে কোনো এক সময়। যে কথাটা বলা প্রয়োজন এই মানুষটিকে যেভাবেই দেখা হোক না কেন তিনি ছিলেন ভোটে অপরাজেয়।

কথায় কথায় সাম্প্রদায়িকতা আর সংখ্যালঘু বিদ্বেষের সমাজে তিনি তার আসনে জিতে আসতেন বারবার। কেবল রিগিং টাকা বা জোর করে অতবার জেতা যায় না। তার চরম দুশমনরাও সে অভিযোগ তুলতে পারেননি। এলাকায় এই জনপ্রিয়তাও দেশের রাজনীতিতে তার অবদানের শুরু যৌবনে। শেষদিন অবধি তা ধরে রেখেছিলেন। বাম দল দিয়ে শুরু ন্যাপ গণতন্ত্রী একতা হয়ে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগে কত ধরনের নেতা, কত জাতীয় মানুষ জায়গা করা এত সহজ কিছু না। তারপরও তার তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি। যেটুকু হয়েছিল মন্ত্রীত্বে। এখনো পরিষ্কার নয়, কি কারণে সেই টাকার থলি কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। যদি তার সচিব দায়ী, যদি তিনি তা জানতেনও আজ এসব কথা না তোলাই ভালো। তারপরও কিছু মানুষের নোংরা প্রতিক্রিয়ায় এটা বোঝা যায় পচে গেছে মেধা। পচে যাওয়া সমাজে চোর, ডাকাত, বাটপারের মিছিলে কে কার দিকে আঙুল তোলে? সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বদলে যাওয়া বাংলাদেশে তার সম্প্রদায়ের কথা বলতে গিয়ে অপমানিত হবেন এটা অস্বাভাবিক না। তাদের আমলের রাজনীতিও এখন অচল। তবু সংসদ সংবিধান বা তুখোড় ভাষণের কথা উঠলেই তাকে মনে পড়বে। সাদাকালোয় মেশানো রঙিন নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আপনাকে গুডবাই।

২. সামাজিক মাধ্যমের বিশাল প্রভাব এখন আমাদের জীবনে। কেউ এর বাইরে নেই। বড় ছোট মহিলা পুরুষ সবাই যার যার মত করে এই মিডিয়ার সাথে যুক্ত। এর দিগন্ত এতই বড় সাত সমুদ্র সাত সাগর সাত মহাদেশ সব তার হাতের মুঠোয়। আমি বলি ফেইসবুক ঘুমায়না। বাংলাদেশের মানুষজন যখন ঘুমমগ্ন আমরা তখন তার ভেতর দিয়ে দুনিয়া দেখা শুরু করি। আবার আমরা যখন ঘুমাই আমেরিকার মানুষজন জেগে ওঠে ফেইসবুক আনন্দে। এই মাধ্যমেই তাঁর সাথে আমার পরিচয়। কখন যেন জর্জবুশ ও টনি ব্লেয়ারকে নিয়ে একটা ছড়া লিখেছিলাম কেমন করে তা যেন তাঁর চোখে পড়েছিল। সেই থেকে যোগাযোগ। জানিনা কেন জীবনের এইপ্রান্তে এসে আমি খুঁজে পেয়েছি মনের মানুষজন। এত মানুষের ভালোবাসা ও সমর্থন আমার মত সাধারণ মানুষের জন্য এক বিশাল পাওনা। তিনি আমাকে সহজেই আপন করে নিয়েছিলেন। কেন জানি তাঁর ধারণা ছিল আমি কোন বিখ্যাতজন। যত বুঝিয়েছি তা আসলে ঠিকনা তিনি মানতেননা। পরে ধীরে ধীরে দেখলাম আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুও তাঁকে ভালো জানে। সাংবাদিক বন্ধু ফারুক ইকবাল, অনুজ লেখক সাংবাদিক রাশেদ রউফ সঙ্গীত শিল্পী শাহরিয়ার খালেদও ছিলেন তাঁর পরিচিত কাছেরজন। মাঝে মাঝে তাঁর বাড়িতে গানের আসর বসাতেন। আমেরিকা থেকে উড়ে গিয়ে চাটগাঁর বাড়িতে এই আয়োজনে শরীক হতেন নামকরা মানুষজন। বলে রেখেছিলেন কখনো যদি আমরা একসাথে চট্টগ্রামে থাকি দেখা হবেই। ফোনে ও কথা হয়েছিল। বলেছিলেন কেউ একজন কিছুতেই আমাকে তাঁর চেয়ে বড় কবি মানতে রাজী হচ্ছিলেন না। খুব মজা পেয়েছিলেন সে ঘটনায়। আমি যত বলি ছেড়ে দিন তিনি তত শিশুর মতো বিষয়টিকে নেড়ে চেড়ে দেখতে চাইতেন। কখনো দেখা হলে সে কবির নাম বলার ও কথা ছিল। আজ আর এসব কিছুই কিছু না।

ব্যক্তিজীবনে সন্তান হারানোর বেদনা নিয়ে বেঁচে থাকা জেসমিন খান আজ কেবলই অতীত। সদ্য প্রয়াত লেখিকা ফাহমিদা আমিনের শোকসভায় ভাষণ দেয়ার পর নিজেও চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তার ক’দিন আগেই বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত রাশেদ রউফকে আপ্যায়ন করেছিলেন চট্রগ্রাম ক্লাবে। সেছবি দেখে আমি ঠাট্টা করে লিখেছিলেম, চিটাগাং ক্লাবে আসবো? তাঁর উত্তর ও দিয়েছিলেন স্বভাব সুলভ দুষ্টুমিতে। সেদিন কি ভেবেছিলাম সেই হবে আমাদের শেষ আলাপ। এমন করে যাওয়াটা ভীতির আপা। এমন যাওয়া বেদনার। আপনি কথা রাখেননি। আমি দেখা না হবার বেদনা নিয়ে আপনাকে স্মরণ করছি জেসমিন খান। যেখানে আছেন ভালো থাকুন।

৩. জীবন যেকোন বেদনা ও মৃত্যুর চেয়ে বড়। সে সতত নদীর মত প্রবহমান। তার বাঁকে বাঁকে যেমন দুঃখ শোক তেমনি আছে আনন্দের ঢেউ। নাহলে মানুষ কবেই পাগল হয়ে যেতো। এই কদিন আগে এক আনন্দ সংবাদে পুলকিত হয়েছি। বাংলা একাডেমি পুরস্কার আমাদের দেশের সাহিত্য শিল্পে বড় ধরনের এক পুরস্কার। এর প্রতীকী মূল্য অসামান্য। চাটগাঁ প্রতিভার সূতিকাগার এর পরতে পরতে মেধা থাকার পরও আমরা ঢাকার চোখে মফস্বল। এই মফস্বল বাণিজ্যিক রাজধানী এর দেয়া টাকায় দেশের উন্নয়নের গাড়ী চলে তরতরিয়ে তবু আজ অবধি আমরা কোন রাষ্ট্রপতি স্পীকার বা প্রধানমন্ত্রী পাইনি। দেশের শিল্পসাহিত্যে চট্টগ্রামের বিশাল ও ব্যাপক অবদানের পর ও পিছিয়ে আছি আমরা। বলাবাহুল্য উভয়দিকে দোষ ত্র“টি আছে বৈকি। এই শহরের লেখক শিল্পীরাও হাত পা গুটিয়ে নিজেদের সীমানায় থাকতে ভালোবাসেন। কেউ ঢাকা গেলে একদিন পর ফেরার জন্য মুখিয়ে থাকেন। স্বয়ংসম্পূর্ণ এই শহর কোনদিকে পিছিয়ে নেই বলেই হয়তো এর মানুষেরা শহর ছাড়তে পারেন না। তারপরও এই খানে থেকেই কেউ কেউ দেশ মাতিয়ে তোলেন। গেলবার আবুল মোমেন যৌথভাবে এই পুরস্কার পাওয়ায় যতটা সান্ত্বনা পুরস্কার মনে হয়েছিল এবার রাশেদ রউফের পাওয়া পুরস্কারটা যেন ততোধিক আনন্দ আর গর্বের। রাশেদের হয়ে ওঠা দেখেছি আমি। বিগত কয়েকবছর তাকে এভাবে এগুতে দেখে আমি বলে রেখেছিলেম তুমি পাবেই। কারণ সে শুধু লেখে না। লেখায়ও। তার হাত ধরে আজ যত লেখক লেখিকা মাঠে আছেন অগ্রজেরা কেউ তা করতে পারেননি। রাশেদের অসীম সাংগঠনিক মেধা আর লেখালেখির ধারাবাহিকতা চট্টগ্রামকে আজ এমন এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে যার ভেতর দিয়ে অতীতের দুঃখ ভুলে সামনে যাবার প্রেরণা দেখতে পাই। রাশেদ রউফ চট্টগ্রামকেই এগিয়ে রাখলো অনেক ধাপ। এই বয়সে এমন অর্জন ভালোবাসার পাশাপাশি শ্রদ্ধারও বটে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কবি ও কলাম লেখক

(সংগৃহীত)

Exit mobile version